রবিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৯

ভালোবাসার অর্থ যখন "ত্যাগ" | অস্মি সেনগুপ্ত



             সৌম্য তার বাবাকে একটা খাতা দিয়ে বললো, "বাবা, স্কুলের ম্যাম সবাইকে বলেছেন জীবনে কার কি স্বপ্ন সেটা খাতায় লিখে নিয়ে যেতে। আমার  টা লিখে দাওনা।"
পুষ্পক কম্পিউটারে কাজ করতে করতেই বলল, "তোমার ম্যাম তোমাকে লিখতে দিয়েছে তো তুমি লেখো, আমি লিখে দিলে কি সেটা ঠিক হবে?"
― কিন্তু বাবা আমি তো লিখতে পারছি না। আর আমার কি স্বপ্ন আমি নিজেই তো জানি না।কখনো আমার ডাক্তার হতে মন চায়, আবার কখনো মনে হয় এরোপ্লেন চালাবো, আবার কখনো মনে হয় সমুদ্র পাড়ি দেব। কিন্তু আমি কি হবো বাবা?ও বাবা বলোনা, বাবা বলোনা।"
― কাজের সময় এইভাবে বিরক্ত করতে নেই।
কথাটা বলেই যেন কোথায় হারিয়ে যায় পুষ্পক। তার ছেলে সৌম্যর দিকে তাকিয়ে থাকে আর নিজের মনে বলতে থাকে, নন্দিনী দেখো, আমাদের ছেলে ঠিক তোমার মত জেদি হয়েছে। তার পরেই ভাবে সৌম্যকে ওর ম্যাম স্বপ্ন নিয়ে লিখতে বলেছে। কিন্তু স্বপ্ন যে ওকে দেখতে দেবনা ঠিক করেছি। মা বলেছিল স্বপ্ন দেখলে নাকি ছেলেরা ভেলভেলে হয়ে যায়, যেমন আমি হয়ে গেছি। না, ওকে স্বপ্ন দেখতে দেওয়া যাবে না। ওকে বোঝাতে হবে স্বপ্ন বলে কিছু হয় না। ওকে বাস্তবটা ভালো করে শেখাতে হবে। কিছুতেই আমি আমার ছেলের জীবন নষ্ট হতে দেব না।
হঠাৎ সৌমিলির ঝাঁকুনিতে সম্বিত ফেরে পুষ্পকের।
―"কি গো, ছেলেটা এতক্ষণ ধরে তোমায় কিছু বলছে আর তুমি শুনছোই না।"
(সৌমিলি সৌম্যকে) "আয় বাবা খেয়ে নে, খাওয়ার পর আমি লিখে দেব।"
― না তুমি লিখে দেবে না। ওকে বলো স্বপ্ন বলে কিছু হয় না। জীবনে যা হবে কেউ আগে থেকে ঠিক করে রাখতে পারে না।
পুষ্পকের জেদের কাছে হার মানে সৌমিলি। পরিস্থিতি সামাল দিতে বলে "খাবার টেবিলে খাবার দিয়েছি, খাবে এস।"
একটু আগে যা হলো তারপর কিভাবে কথাটা বলবে বুঝতে পারছেনা। তাও অনেকটা সাহস জুগিয়ে বিছানায় শোবার পর বলল, "আমরা কোনোদিন একা কোথাও ঘুরতে যাইনি। প্রত্যেকবার  হয় পরিবারের সবাই, না হয় তোমার হোমের সবাই, না হয় তোমার কলিগরা গেছে আমাদের সাথে। সামনেই ১৫ই অগাস্ট আমাদের ১০ম বিবাহবার্ষিকী। ওই দিন কি আমরা মানে শুধু তুমি আর আমি কোথায় ঘুরতে যেতে পারি?" বলেই তার চোখেমুখে যেন এক খুশির বাতাস বয়ে গেল।
ঘর অন্ধকার থাকলেও সেই খুশির আভাস পুষ্পক ঠিকই পেলো। সে জানতো তারা একা কোথাও ঘুরতে গেলে সৌমিলি ঠিক তার মনে পুরো জায়গাটা করে নিতে পারতো। কিন্তু তার মনে নন্দিনীর জন্য যে জায়গাটা আছে সেটা সে কিছুতেই তাকে দিতে পারবে না। ফুলশয্যার রাতেই তাকে জানিয়েছিল, "দেখো তোমার সব দায়িত্ব আমার। তুমি সব পাবে; ভালোবাসা, সম্মান, মর্যাদা— সব। কিন্তু আমার মনে নন্দিনীর জন্য যে জায়গাটা আছে সেটা নষ্ট করতে বোলো না, তাহলে আমি আর বাঁচবো না।"

অনেক স্বপ্ন নিয়ে আসা নববধূ সৌমিলি কথাগুলো ঠিক মত বুঝতে না পারলেও কথাগুলো তার মনের মধ্যে গাঁথা হয়ে গিয়েছিলো। সে হাসি মুখে বলেছিল, "ঠিক আছে তাই হবে।"
তারপর থেকে সৌমিলি তার শশুরবাড়িকে আপন করে নিয়েছিল। অল্পদিনের মধ্যেই তার অগোছালো  শশুরবাড়ীকে ভরিয়ে তুলেছিল আনন্দে। পরে সবার কাছে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছিল, নন্দিনীর সাথে পুষ্পকের বিয়ে ঠিক হয়েছিল সম্বন্ধ করেই। দুই বাড়ি থেকেই সবাই খুব খুশি ছিল। নন্দিনী আর পুষ্পক তখন প্রেমের জোয়ারে ভাসছে। বিয়ে হতে আর কিছু দিন বাকি। হঠাৎ কোনো এক অজানা ঝড় এসে সব শেষ করে দিলো। বিয়েটা আর হলোনা। তার পরেই পুষ্পকের বাড়ির সবাই ভেঙে পরে। আর পুষ্পক পাগলের মতো হয়ে যায়। তার কষ্ট দেখে সবাই ভাবলো তার বিয়ে দিলে হয়তো পরিস্থিতির সামাল দেওয়া যাবে। তাই তারা সৌমিলির সাথে পুষ্পকের বিয়ের ব্যবস্থা করে। সৌমিলি পুষ্পরকের মায়ের এক দুঃসম্পর্কের আত্মীয়ের মেয়ে। পুষ্পক প্রথমে না করলেও মায়ের কথায় বিয়েতে রাজি হয়। পুষ্পক আর সৌমিলির বিয়ের কিছুদিন পর নাকি নন্দিনী শিলিগুড়ি বেড়াতে গিয়ে পাহাড় থেকে পড়ে মারা যায়। যদিও তার ডেডবডি খুঁজে পাওয়া যায়নি।

সেদিন সবটা জানার পর মনে মনে বলেছিল, "কি বোকা মেয়ে। এত ভালো পরিবার আর পাগলের মতো ভালবাসা বরকে ছেড়ে গেল কি করে। শুধু শুধু বিয়েটা ভেঙ্গে দিলো।" সৌমিলির মন যেন মানতে চায়না। ব্যাপারটা সবাই সহজ ভাবে নিলেও তার মোটেই সহজ মনে হচ্ছে না। সবাই নন্দিনীকে ভুল বুঝলেও তার মনে হচ্ছিল কোনো বড় কারণ আছে এর মধ্যে। কিন্তু সৌমিলির মন অত ভারী কথা নিতে পারে না। সহজেই মানিয়ে নিতে পারে। তার মনে হলো, ভাগ্যিস নন্দিনী সেদিন না করেছিল, নাহলে হয়তো তার কপালে এত ভালো শশুরবাড়ি আর এত ভালো বর জুটত না। আজ সৌমিলি সবার মনে নিজের জায়গা করে নিতে পেরেছে। পুষ্পকও তাকে খুব ভালোবাসে। তার সব ইচ্ছা পূরণ করে। নন্দিনী যদি তার মনের একটা অংশে থাকে তো ক্ষতি কি? সে তো এসে আর পুষ্পককে তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে যেতে পারবে না। এইভেবেই সৌমিলি সব মেনে নিয়েছে হাসি মুখে।
পুষ্পক ভাবে যে সত্যি মেয়েটা আমাকে আর আমার পরিবারকে অনেক কিছু দিয়েছে। কিন্তু ওকে নিয়ে কোথাও একা ঘুরতে যাওয়া হয়নি।
— "ঠিক আছে নিয়ে যাব। তুমি কোথায় যেতে চাও বলো আমি টিকিট বুক করে নিচ্ছি।"
কিছু না ভেবেই সৌমিলি হঠাৎ বলল, "আন্দামান"।
পুষ্পকের বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল।সে আর নন্দিনী হানিমুনে আন্দামান যাবে ঠিক করেছিল।সব প্ল্যান হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যাওয়া আর হল না।
নিজেকে সামলে নিয়ে পুষ্প বলল, "অন্য কোথাও গেলে হয় না? তুমি যেখানে বলবে সেখানেই নিয়ে যাবো কিন্তু আন্দামান আমার যেতে ইচ্ছা করছে না।"
সৌমিলি যাওয়ার খুশিতে এতটাই বিভোর যে পুষ্পকের কথা শুনেও শুনতে পেল না।
― আমি নেটে ছবিগুলো দেখেছি। খুব সুন্দর জায়গা। সৌম্যকে ওর দাদু ঠাকুমার কাছে রেখে যাবো, এই কয়েকটা দিন ওরা ম্যানেজ করে নেবে। আর আমি সব কিছু প্যাকিং করে নেব তুমি চিন্তা করো না। কিছু কেনাকাটা করার আছে সেগুলো তুমি আর আমি একদিন গিয়ে নিয়ে আসবো।"
সৌমিলির যাওয়া নিয়ে এত উৎসাহ দেখে পুষ্পক আর না করতে পারলো।
পুষ্পক তারা ভরা অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো, "দেখো নন্দিনী তুমি চেয়েছিলে আমরা আন্দামান যাই, আমি আজ যাচ্ছি ঠিকই কিন্তু তুমি কোথায়?"

যথাসময়ে পুষ্পক আর সৌমিলি পাড়ি দিলো আন্দামানে। ১৪ই অগাস্ট আন্দামান দ্বীপে নামলো দুজনে। সৌমিলি আবদার করেছিল ১৫ই অগাস্ট বিবাহবার্ষিকীর দিন ঘটা করে নীল ডাউন হয়ে লাল গোলাপ দিয়ে তাকে ভালোবাসার কথা জানাতে হবে। কথাগুলো পুষ্পকের কাছে বাচ্চাদের বায়না মনে হলেও সে একটা হোটেলে সব ব্যবস্থা করে রেখেছে।

১৫ ই অগাস্ট সকালে দুজনের সমুদ্রের ধারে ঘুরতে বেরিয়েছে।পুষ্পকের চোখ ক্যামেরার লেন্সে। ছবি তোলার শখটাও নন্দিনী যেন তার মধ্যে জাগিয়ে তুলেছিল, যেটা সে আজও ছাড়তে পারেনি। হঠাৎ ক্যামেরার লেন্সে ভেসে উঠলো সেই পরিচিত মুখ। এ কি দেখেছে পুষ্পক? নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সে কী স্বপ্ন দেখছে? নাকি এটা বাস্তব? এসব ভাবতে ভাবতেই সেই চেনা মুখটা আবার হারিয়ে গেলো। লেন্স থেকে চোখ সরিয়ে তাকিয়ে দেখল তাকে কেউ নিয়ে চলে যাচ্ছে। কি করবে ভেবে না পেয়ে "নন্দিনী নন্দিনী" বলে তার পিছনে পাগলের মতো ছুটতে লাগলো।

অনিশ প্রথমে খেয়াল না করলেও কিছুক্ষণ পর তার খেয়াল হলো কেউ তাদেরকেই ডাকছে। ফিরে তাকাতেই দেখলো একজন ভদ্রলোক "নন্দিনী" চিৎকার করতে করতে তাদের দিকে আসছে।
সেই চেনা পরিচিত মেয়েটির হাতটা ধরে হাঁপাতে হাঁপাতে পুষ্পক বললো, "কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে? কত খুঁজেছি তোমায়। কেমন আছো?"
মেয়েটি বলল, "এক্সকিউজ মি!! হু আর ইউ?"
— আমায় চিনতে পারছো না? আমি তোমার পুষ্পক।
অনিশ ব্যাপারটা সামাল দিতে বলল, "আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। আপনি হয়তো একে অন্য কারো সাথে গুলিয়ে ফেলেছেন। শি ইজ মাই ওয়াইফ, শ্রী।"
এতক্ষণ সব কিছু স্বপ্নের ঘোরের মতো লাগছিলো সৌমিলির। সে নন্দিনীকে কখনো দেখেনি, ছবিও দেখেনি। তাই সে বুঝতে পারছে না কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যে। তবে তার সিদ্ধান্ত নিতে খুব একটা দেরি হলো না। কারণ এর আগেও পুষ্পক ওকে নন্দিনী বলে অনেকবার ডেকেছে। জ্বরের মধ্যেও নন্দিনীর নাম আউড়েছে। হয়তো মেয়েটিকে নন্দিনীর মতো দেখতে বলে সে এরকম করছে ভেবে বলল, "ক্ষমা করবেন।ওর ভুল করে ওনাকে নন্দিনী ভেবেছে। কিছু মনে করবেন না। আপনারা আসতে পারেন।"
কথাগুলো বলেই সৌমিলি পুষ্পকের হাত শক্ত করে ধরে উল্টো দিকে টানতে টানতে নিয়ে গেল। পুষ্পক যেতে না চাইলেও সৌমিলির জেদের কাছে পরাস্ত। তাও সে সৌমিলিকে বার বার বোঝাতে চাইলো "ও আমার নন্দিনী।" যদিও পুষ্পক ব্যাপারটা নিজেই কিছুতে বিশ্বাস করতে পারছিল না। তাও চোখের সামনে নন্দিনীকে দেখে তার সত্য মিথ্যা সব মিলে মিশে এক হয়ে গিয়েছিল। শ্রীও তার স্বামী অনিশের হাত ধরে চলে গেল। অনিশ যদিও স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে কিন্তু কেন যেন হতে পারছে না। কোথাও যেন অজানা ভয় তার মনে বাসা বেঁধেছে।

পুষ্পক অনেক খোঁজ করে দুপুরের মধ্যেই তাদের ঠিকানা জোগাড় করে তাদের বাড়ি গিয়ে উপস্থিত। দরজার কলিং বেল বাজানোর কিছুক্ষণ পরেই শ্রী এসে দরজা খুলল। হটাৎ সেই সকালের দেখা ভদ্রলোকটিকে দেখে কিছুটা ভয়েই চিৎকার করে উঠলো, "শুনছো, দেখো সেই লোকটি আবার এসেছে। কোথায় তুমি তাড়াতাড়ি এসো।"
হটাৎ এরকম চিৎকার শুনে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে পুষ্পক বলল, "দয়া করে চিৎকার করবেন না। আমি জাস্ট কিছু কথা জানতে চাই। খুব দরকার আমার উত্তর গুলো।"
এরমধ্যেই অনিশ আসে। শ্রীকে শান্ত করে বলে, "আচ্ছা আমি দেখছি ব্যাপারটা।তুমি চা করে নিয়ে এসো। আপনি ভেতরে আসুন।"
দুজনে চেয়ারে মুখোমুখি বসে কথপোকথন শুরু করলো।
— হ্যাঁ বলুন,কি বলতে চান।আর আমাদের বাড়িতেই আসার কারণটা কি?
— সব বলবো। আসলে আমার সব যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। কোথা থেকে শুরু করবো বুঝতে পারছি না।"
—আপনার যেখান থেকে সুবিধা মনে হয় বলুন"।
— আপনাদের কথা শুনে মনে হয়েছে আপনারা বাঙালী। মানে আপনাদের এখানে বাড়ি নয়। আর উনি কি আপনার স্ত্রী? আপনাদের কতদিন আগে বিয়ে হয়েছে?
— হ্যাঁ ও আমার স্ত্রী, শ্রী। আমাদের প্রায় নয় বছর আগে বিয়ে হয়েছে। কিন্তু আপনি এসব জিজ্ঞাসা করছেন কেন? আপনি কে?
― ও সরি,আমার পরিচয় টাই দেওয়া হয়নি। আমি পুষ্পেন্দু বেরা। কলকাতায় থাকি। ওখানে আমার ছোট একটা বিজনেস আছে। এছাড়াও একটা বাচ্চাদের হোম আর একটা বাচ্চাদের স্কুল চালাই। যদিও অনেকেই আমাকে হেল্প করে। বুঝতেই তো পারছেন একা হাতে এত কাজ করা সম্ভব নয়।
― সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু আপনার আমার সাথে দরকারটা কোথায়?
― বলছি, সব বলছি। আসলে আপনার সাথে সকালে যাকে দেখেছিলাম মানে আপনার স্ত্রীকে হুবহু আমার নন্দিনী মানে আমার এক্স গার্লফ্রেন্ডের মত দেখতে। আমাদের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিশেষ কারণবশত ও বিয়েটা ভেঙ্গে দিয়েছিল। তারপর হটাৎ একদিন খবর পেলাম ও শিলিগুড়িতে বেড়াতে গিয়ে পাহাড় থেকে পড়ে মারা গেছে। আজ তাকে জীবিত চোখের সামনে দেখছি অথচ সে আমাকে চিনতে পারছে না। হয় সে মিথ্যে বলছে অথবা এটা আমার মনের ভুল। আচ্ছা আপনার সাথে ওনার বিয়ে হলো কিভাবে? মানে ওনার সাথে আপনার পরিচয় কিভাবে?
কথা গুলো শুনতে শুনতে অনিশের বুকের ভেতরটা যেন শূন্য হয়ে আসছিল। কি উত্তর দেবে খুঁজে পাচ্ছিল না। সেই সময় শ্রী চায়ের ট্রে নিয়ে এলো— "কী কথা হচ্ছে? অনিশ, উনি কে? কেন এসেছেন?তুমি ওনাকে চেনো?"
― তেমন কিছু না। আমার একটা কেস নিয়ে কথা বলছি। তুমি ওপরে গিয়ে রেস্ট নাও। আমি আসছি এক্ষুণি।
শ্রী বাধ্য মেয়ের মতো ওপরে চলে যায়।
― হ্যাঁ বলছিলাম যে ওনার সাথে আপনার বিয়ে হলো কি করে?
– বলছি। আপনি চা নিন।
― আগে আমার প্রশ্ন গুলোর উত্তর দিন। আমি আর এই রহস্য সহ্য করতে পারছি না।
― ওর সাথে আমার শিলিগুড়িতে প্রথম দেখা। আমি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। আমার পোস্টিং তখন শিলিগুড়িতে। একদিন সকালে পাহাড়ের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় ওকে রাস্তার পাশে রক্তাক্ত অবস্থায় পরে থাকতে দেখি। কাছে গিয়ে দেখলাম পালস চলছে তখনও কিন্তু খুব সিরিয়াস কন্ডিশন। কিছু না ভেবেই তাড়াতাড়ি রাস্তার মাঝে একটা গাড়ি থামিয়ে ওকে হসপিটালে নিয়ে যাই। ডক্টর দেখে বললেন যে ওদের হাতে কিছু নেই। খুব সিরিয়াস কন্ডিশন। তাও ওনারা সাধ্য মতো চেষ্টা করবেন। তবে দু দিনের মধ্যে ওর জ্ঞান না ফিরলে কোমায় চলে যাবে অথবা শরীরের একাংশ প্যারালাইসিস হয়ে যাবে। শুনে কিছুটা চমকে উঠলাম। ভাগ্যক্রমে  দুদিনের মধ্যে ওর জ্ঞান ফিরলো। কিন্তু ও কিছুই মনে করতে পারছিল না, ও কে বা ওর ঠিকানা কি? থানাতে কয়েকবার খোঁজ নিয়েও সুবিধা হয়নি। ওর সুস্থ হতে একমাস লেগেছিল। এর মধ্যে ওর কোনো খোঁজ খবর নেয়নি কেউ। পরে ডাক্তারের রিপোর্ট দেখে বুঝলাম ওর ব্রেইনের একটা অংশ ব্লক হয়ে গেছে তাই কিছু মনে করতে পারছে না। জোর করে কিছু মনে করতে চাইলে ওই অংশে চাপ পড়লে পাশাপাশি নার্ভগুলো ছিঁড়তে থাকবে, ফলে মৃত্যু অনিবার্য। তাই আমার ট্রান্সফার নিয়ে ওকে আন্দামান নিয়ে এলাম। কিছুটা স্বার্থের কারণেও বলতে পারেন। কারণ ওর সরল মুখখানা কিছুতেই যেন চোখের সামনে থেকে সরাতে পারছিলাম না। নিজের অজান্তেই খুব ভালোবাসে ফেলেছিলাম। ও আমার সাথে আসতে কোনো আপত্তি করেনি। আর আমার তিনকুলে কেউ নেই। মা বাবাকে ছোটোতেই হারিয়েছি। আত্মীয়ও তেমন কেউ নেই। তাই কোনো অসুবিধা হয়নি। তারপর ওর সাথে থাকতে থাকতে বুঝলাম ওরও আমাকে ভালোলাগে। আমরা বিয়ের সিদ্ধান্ত নিই। তারপর থেকে এখনও পর্যন্ত আমি ওর সব আর ও আমার। তবে আমি ওর সাথে কথা বলে বুঝেছি ও খুব বড় আঘাত পেয়েছিল, যেটা ও সহ্য করতে পারেনি। তাই ওর মস্তিষ্কে ব্লকেজ হয়েছে। তাই ওকে যতটা পারি খুশি রাখার চেষ্টা করি।
কথা গুলো বলে যেন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনিশ।
―আচ্ছা আপনার কথা অনুযায়ী যদি ও নন্দিনী হয় তো ওর এই মনের গভীর ক্ষতের কারণ কি জানেন? মানে কি এমন হয়েছিল? শুধু বিয়েটা ভাঙার জন্য?
―আপনাদের তো নয় বছর বিয়ে হয়েছে বললেন তো আপনাদের ছেলেমেয়ে কাউকেই তো দেখছিনা।
―নো, আমাদের কোনো ইস্যু নেই। আসলে শ্রীর একটা প্রবলেমের জন্য  কনসিভ করতে পারবে না। এই কারণেই কি আপনি ওকে বিয়ে করতে চাননি?
―না। বিশ্বাস করুন আমি এটা জানতাম না। ইন ফ্যাক্ট নন্দিনীই এই বিয়েটা ভেঙেছিল। আজ আমার কাছে সবটা জলের মতো পরিষ্কার। খুব বড়ো ভুল হয়ে গেছে আমার।

সৌমিলি এর মধ্যেই শাশুড়ীকে ফোন করে সকালের ঘটনাটা জানিয়েছে। এছাড়াও আজকের সন্ধ্যার ব্যাপারটাও জানিয়েছে। সে আজ খুব খুশি। ইতিমধ্যেই পার্লারের খোঁজ নিয়ে সেখান থেকে রেডি হয়ে গেছে। আজ যেন তাকে সব থেকে সুন্দর লাগে। কিন্তু সকালের ঘটনার পর ওর ভয় করছে। কোথায় যে পুস্পক বেরিয়ে গেল। আবার মনে মনে ভাবল, হয়তো ওকে কোনো সারপ্রাইজ দেবে সেটার ব্যবস্থা করছে। ইতিমধ্যে ও কয়েকবার ফোন করেছে কিন্তু সুইচড অফ আসছে। হয়তো এসে ওকে চমকে দেবে, তাই আগে থেকে যাতে বলে না ফেলে এই ভয়েই ফোন অফ করে রেখেছে। সৌমিলি নির্দিষ্ট জায়গায় পুষ্পেন্দুর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। সে বারবার ঘড়ির দিকে তাকাতে লাগলো। সে এই মুহূর্তটার জন্যই এতদিন অপেক্ষা করে আছে কিন্তু আর ধৈর্য ধরে থাকতে পারছে না।
পুষ্পেন্দু তার চোখের জল আর ধরে রাখতে পারছে না। এতদিন ধরে সে যাকে দোষী ভেবে এসেছে সে আজ তাকে সব কিছু ফিরিয়ে দিয়ে নিজে নিঃস্ব হয়ে গেছে। সামনে বসে থাকা অনিশকে সে কি জবাব দেবে বুঝতে পারছিল না। নন্দিনীর এই অবস্থার জন্য যে শুধু সে দায়ী। তাই বলল, "নন্দিনীর বিয়ে ভাঙার কারণটা কেউ না বুঝলেও আজ বুঝতে পারছি। ওকে সবাই  ভুল বুঝেছিল, এমনকি আমিও। সবাই ওকে একটা খামখেয়ালি মেয়ে ভেবেছিল। তাই ওর আত্মীয়, বাবা-মা সবাই ওকে দোষ দিয়েছিল। আসলে সবাই ওকে খুব ভালোবাসতো। তাই এরকম কঠিন সিদ্ধান্তের পিছনে কারণ বুঝতে না পেরে ওকে ভুল বুঝেছিল। আর নন্দিনীও কাউকে ওর কষ্টের কথা বোঝাতে পারেনি। নিজেই গুমরে গুমরে শেষ হয়ে গেছে তবু কাউকে দোষ দেয়নি। আমিও বুঝতে পারিনি।যাকে এত ভালোবাসলাম তার কষ্টের কারণটাই বুঝলাম না!! যদি ওর কোনোদিন স্মৃতি ফেরে ওকে বলবেন ওর ইচ্ছা মত একটা বাচ্চাদের হোম করেছি, সেখানে অনাথ শিশুদের থাকার ব্যবস্থা করেছি। আর একটা বাচ্চাদের স্কুল, যেখানে গরিব ও অনাথ বাচ্চাদের ফ্রীতে পড়ার ব্যবস্থা করেছি। ওর সাথে আমি যে অন্যায় করেছি, এগুলো করলে ওর প্রতি অন্যায়টা যদি একটু কমে তাতেই আমি ধন্য। ওকে বলবেন ও আজ অনেক সন্তানের মা। আমার হোম আর স্কুলের নাম নন্দিনীর নামেই করা।"
তারপর পুষ্পেন্দু নিজের পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে দিয়ে বলল, "এই আমার কার্ড। যদি কখনো মনে হয় ওকে একবার নিয়ে যাবেন। আফসোস এটাই, যার জন্য এতকিছু করা আজ সে থেকেও দেখতে পারবে না। আপনারা ভালো থাকবেন। আসি।" বলে পুষ্পেন্দু দুহাতে চোখ মুছতে মুছতে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। অনিশও তাকে অনেক কিছু বলতে চাইলো কিন্তু কোথাও যেন আটকে গেলো। বলতে গিয়েও বলতে পারল না। একছুটে ঘুমন্ত শ্রীর কাছে গিয়ে পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, "তোমায় আমি খুব ভালোবাসি শ্রী। আমাকে ছেড়ে কখোন যেও না।"

পুস্পকের কাছে আজ সব পরিষ্কার। নন্দিনী ওকে বারবার বোঝাতে চেয়েছিল যে ও মা হতে পারবে না। কিন্তু পুস্পক আর ওর বাড়ির সবার ওদের সন্তান হওয়া নিয়ে এত উৎসাহ দেখে সে তাদেরকে সত্যিটা বলার সাহস পায়নি। তাই সে বিয়ের পর হাজার লাঞ্ছনার চেয়ে বিয়ের আগে শত অপমান সয়ে সরে গেছে তার জীবন থেকে। তাই হয়তো ভগবান তাকে তার প্রাপ্য পুরস্কার দিয়েছে। তার বাবা মা আত্মীয় স্বজন সবার ভালোবাসা কেড়ে নিলেও অনিশের মতো একজনকে তার জীবনসঙ্গী হিসাবে পাঠিয়ে দিয়েছে।

এসব ভাবতে ভাবতে পুস্পক হোটেলে ফিরে আসে। কিন্তু সৌমিলি কোথায়? হঠাৎ খেয়াল হয় সৌমিলিকে তো আজ ওর ভালোবাসার কথা জানানোর ছিল। এত দিন ধরে ও সৌমিলির সাথেও অন্যায় করেছে। সত্যি তো, সৌমিলির দোষটা কোথায়? ও নিজের ভালোবাসা পাবে না কেন? সৌমিলিকে আজ সব বলা দরকার। কিন্তু সৌমিলি কোথায়? ঘড়ির দিকে তাকালো পুস্পক। নয়টা বাজে। তাহলে কী সৌমিলি তিন ঘন্টা ধরে তার জন্য ওয়েট করছে?

পুষ্পেন্দু দৌড়ে হোটেলের ছাদে গেল যেখানে সে সবকিছু অ্যারেঞ্জ করেছিল। সেখানে গিয়ে দেখল সৌমিলি একা বসে তার জন্য অপেক্ষা করছে। সৌমিলিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো পুস্পক।
― কী হয়েছে তোমার, কাঁদছো কেন? আর কোথায় ছিলে এতক্ষণ?
― আমি তোমায় অনেক কষ্ট দিয়েছি। আমাকে ক্ষমা করো। তুমি আমাকে আর একটু সাহায্য করো।
― কি সব বলছো কিছুই বুঝতে পারছি না।
― বোসো সব বলছি।
তারপর পুস্পক তার জীবনের আজ পর্যন্ত সব ঘটনা বলল। সৌমিলিও তার চোখের জল আটকাতে পারলো না।
― ঠিক আছে, এত দিন পর্যন্ত তোমার সব কাজে আমি পাশে ছিলাম আজও থাকবো। শুধু তোমার এই বন্ধুসত্ত্বাটা আমাকে দিও।

আজ যেন সৌমিলির চোখের জল সুখের বার্তা নিয়ে এলো। আজ সে তার পুস্পককে ফিরে পেলো। আজ প্রথম পুস্পক নিজের থেকে তার মনের সব কথা সৌমিলিকে বলল। আজ যেন তারা নতুন করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলো। শুরু হল তাদের নতুন পথ চলা।



                                                                                  © অস্মি সেনগুপ্ত

0 Comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আপনার মতামত দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ , খুব শীঘ্রই আপনাকে উত্তর দেওয়া হবে :-)