বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৯

" সেদিন " - মনোজ রায়


মনে পরে সেদিনের সেই দিনটি?
যেদিন বসে ছিলাম তুমি আর আমি
করে অধিকার পার্কের সেই কোনটি।

একটানা বৃষ্টি পড়ছিল মুষল ধারায়।
চেয়েছিলাম ভিজতে, কিন্তু পারিনি
তাই এসেছিলাম দুজনে এক ছাতার তলায়।

নিঃশব্দে কাটিয়েছিলাম অনেকটা সময়
একে অপরের দিকে চেয়ে, কি যেন
এক অদ্ভুত অনুভূতি জেগেছিল অন্তরময়।

হয়তো তুমিও বুঝেছিলে সেই অনুভূতি-
সেদিন কিছুই বলতে পারিনি।
ভয় ছিল মনে, তোমায় হারাই যদি...।

বৃষ্টি থামলে... করছিলে তাড়াহুড়ো
"বাড়ি যেতই হবে, হয়েছে দেরি"
ঘড়িতে তখন বেজেছিলো পাঁচটা বারো।

তুমি গেলে চলে নিজের পথ ধরে;
যেন আরো কিছু সাথে নিয়ে-
ভাবিনি নেবে তুমি আমাকেও আপন করে॥


                                      ©  মনোজ রায়  ©

" মেশানো উষ্ণতা " - ধ্রুব বিকাশ মাইতি


আমি মিশে গেছি......
অসময়ের বাঁধভাঙা বৃষ্টির শীতল মেজাজে,

সে আমায় গভীর শ্বাসে নিমেষের মধ্যে
বার বার জড়িয়ে ধরেছে আগন্তুক পথে,

শরীরগুলো সব লতিয়ে লতিয়ে পড়ছে I

ওরা যে ভালোবাসায় মিলনের কাঙাল!
তোমরা ওদের একটু ভালোবাসা দাও;
দেখবে ওরাও উজার করে সবটাই দেবে।

কিছু মানুষ-জন দেখি সবুজ মাঠে-ঘাটে
ওদের সাথে জড়াজড়ি করছে তৃষ্ণায়।

আর আমি কিছুক্ষণ আদর করার পর
লুকোতে চেয়েছিলাম কারোর বারান্দায়..
কিন্তু তখনও দেখি আমায় জড়িয়ে রেখেছে,
দুজনের মিলনের নতুনে মেশানো উষ্ণতা
মাটিতে ঝরছে বাসন্তিকের নব আবেগে।

তারপর আবার অনেকটা... সময় মিশেছি।


                                © ধ্রুব বিকাশ মাইতি ©

মঙ্গলবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৯

" আমার আমি " - প্রিয়া কর্মকার


                   মার 'আমি'টার গত দুদিন আগে মৃত্যু হয়েছে, এক ভীষণ বড়ো ধরনের ধাক্কায়। না না... কোন বাহ্যিক দুর্ঘটনায় ঘটেনি তার সাথে। ঘটলে লিখতাম কী করে তার মৃত্যু কাহিনি? হাহাহা...!! তবে সে যে আর বেঁচে নেই এবং ক্ষণিক সময়ের বেড়াজালে কিভাবে তার তিলে তিলে মৃত্যু হল সে কেবল নিজেই উপলব্ধি করেছি। তবুও তার মৃত্যুর অনুভূতি আরেকজনও নিশ্চয়ই পাচ্ছে। থাক সে কথা। সে তো জানতোই যে আমার 'আমি'টা কতখানি অভিমানী। আমার 'আমি'টা এমনিতেই নানান কারণে ভীষণ রকম দুর্বল ছিলো, কোনো কিছুই ভালো লাগত না তার। তবে তার মৃত্যুর মাস ছয়েক আগে থেকে তাকে হাসিখুশিতে উজ্বল থাকতে দেখেছিলাম সবর্দা। যে কারণেই হোক না কেন তার খুশি আমি মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু, কারণটা যখন আজ অনেক কারণ দেখিয়ে আমার 'আমি'কে অস্বীকার না করলেও স্বীকার করতে দ্বিধা বোধ করছিলো, তখন আমার 'আমি' আর বোধহয় সহ্য করতে পারলো না এই অভাবনীয় ধাক্কাটা। তাই সে চলে গেল, তাকে ছেড়ে। তবে নিঃস্ব করলো না আমাকে বা তাকে। দিয়ে গেল অফুরন্ত শক্তি, লেখনি শক্তি। তবে প্রশ্ন একটাই, এই মায়াময় পৃথিবীর মায়াজাল কাটিয়ে ওঠা আমার একার পক্ষে কি সম্ভব হবে? ভীষণ ভয়ও হয়, কোনো এক অদৃশ্য মায়াজালে নতুন কোনো ক্ষতের দাগ পেতে কোনভাবেই পুনর্জন্ম লাভ করবে না তো আমার 'আমি'টা? সত্যিই জানি না।


                                                                © প্রিয়া কর্মকার ©

" খেলনাপাতি " - শিবাশিস মৌলিক


মন কি তোর খেলনাপাতি?
খেলবি শুধুই ভাঙাচোরার খেলা!
খেলনাবাটি নিয়েও তো
 স্বপ্ন দেখে মেয়েরা —
মা সেজে সংসার করার।

বয়স বাড়লে স্বপ্নে বদল হয়
বদলায় মানুষের মন!
প্রয়োজনে বদলায় সঙ্গীও।
তা বলে অকারণে?

তোর সঙ্গে খেলব ভাবি
অন্তহীন খেলা,
হার-জিতহীন খেলা।
তুই বারবার খেলা ঘেঁটে দিস
নষ্ট করিস সময়,
জেতার সুযোগ।

আমি হারলেই কি জিতিস তুই?
নাকি হেরে গিয়েই
মিলিত হই দুজনে।
পরাজিতের আসনে
আমি তুই একাকার।



                                           © শিবাশিস মৌলিক ©

" একটু আশা " - বিউটি ঘোষ


তোর জন্য স্বপ্ন দেখি নয়ন ঠুলি উঠিয়ে তাই-
বিশ্বজগৎ কাঁপিয়ে দিয়ে বলবো শুধু তোকেই চাই।
লিখে দেখো চলার পথে জানবে প্রতি ধূলিকণা,
আমি আপন পথভুলা যে, হতে পারিস তুই আনমনা।
ফিরিয়ে নিয়ে আসবো আমি স্বর্গ পথেও দেবো পাড়ি।
ভাঙ্গবো আমি হাজার দুয়ার স্বর্গ পথে ওই যে তারই।
দত্যি-দানব এক হয়েছে কেড়ে নিতে আমার গতি, 
আমার অহং গতির ধারায় দেখবো তাদের পরিণতি।
শুকনো কাঠেও ধরবে যে ওই পুষ্পশাখার হাজার শাখি;
আজও আমি বিশ্বমাঝে তোকে নিয়েই স্বপ্ন আঁকি॥

                                          © বিউটি ঘোষ ©

" জীবনপণ " - আবুল হাসেম


ভাবনাশক্তির প্রখরতাই আমি দর্শন পেয়েছি সেই জগৎ,
যা সবার দৃষ্টির অগোচর।
কল্পনাময় জগৎ থেকে তাকে বাস্তবে টেনে আনবোই আপন শক্তিতে।
মানব মনের পশুত্বকে বশ করবো আপন ভাবনা শক্তির তীব্র প্রভাবে।
নবজাতকের অবতারে প্রবেশ করাবো আপন চিন্তন শক্তি।
মানবের অন্তরে লিপিবদ্ধ করবো আপন ভাষা। 
তাদের মুখের ভাষাই আমার প্রাপ্তি
দেবে গতি আপন পথের ধারায়।
সেই ভাবনাতেই জাগ্রত চিত্তে রয়েছি সদা।


                                                © আবুল  হাসেম ©

" মস্ত লেখক " - অরুণোদয় ভট্টাচার্য



 আমি মস্ত লেখক সারা রাত জেগে রই
 আমার মাসে মাসে মোটা মোটা বেরচ্ছে বই ।
 আমার ছড়া যায়না পড়া
  ছন্দমিলের বালাই ছাড়া,
  গল্প আমার যুগান্তকারী
  মুড়ো-ল্যাজা কেউ না পায় থৈ ।

 আমার প্রতিভা সে আবার বহুমুখী,
 নাটক যা লিখি ফর খোকা-খুকী ।

 উপন্যাসের এমন বিন্যাস
 জানত কেবল গ্রেট বেদব্যাস,
 আমার essay প'ড়ে হেসে
 কুটোপাটি নিজে যে হই ।


                                        © অরুণোদয় ভট্টাচার্য ©

" হঠাৎ দেখা " - মনোজ রায় | সম্পূর্ণ গল্প



— এতো বছর পরেও তুই শুধরালি না, কথায় কথায় রাগ করার স্বভাবটা এখনো রয়ে গেছে তোর। 
— হুমম কিছু কিছু স্বভাব এতো সহজে যায় নাকি? 
— মা হয়ে গেছিস তুই, এখনো সেইরকম আছিস। 
— একদম। তুই কেমন আছিস? 
— যা আছি এই তোর চোখের সামনেই। 

            আজ প্রায় সাত-আট বছর পর হঠাৎ দিল্লী এয়ারপোর্টে আদৃজা আর আদিলের দেখা। একে অপরকে দেখে বিশ্বাসই করতে পারছে না যে তারা একে অপরের মুখোমুখি হয়ে বসে আছে। তাদের পুনরায় যে দেখা হবে সেটা কখনোই কল্পনা করেনি তারা। অবশ্য এভাবে অবাক হওয়ার কারণও আছে। গত ৮ বছর দুজনে আলাদা জীবন কাটালেও ৮ বছর আগে একে অপরকে ছেড়ে এক মুহূর্তও থাকতে পারতো না তারা। একে অপরকে খুব ভালো বাসতো যে। বিয়েও করতে চেয়েছিলো তারা। সবকিছু ঠিক ও হয়ে যায়। কিনতু একটি সম্পর্ক তৈরী করাটা যতটা সহজ, সেটা সামলে চলাটা ততটাই কঠিন। 

              সেদিনটা ছিল আদৃজা এবং আদিলের বিয়ের ঠিক আগের দিন। দুজনেই খুব খুশি ছিল, আদৃজা হাতের মেহেন্দির দিকে বারবার তাকাচ্ছিলো আর মনে মনে হাসছিল। আর কয়েক মুহূর্তের অপেক্ষা। তারপর একে অপরের কাছে আসতে আর কোনো বাধা থাকবে না দুজনের। আদৃজা নিজের হাতের মেহেন্দিটা দেখাবে বলে কল করল আদিলকে। কিন্তু এতো রাতে আদিলের ফোন ব্যাস্ত? কোথায় ব্যাস্ত আদিল? টানা ১৫ মিনিট আদৃজার কল ওয়েটিং থাকার পরও আদিলের কোনো উত্তর নেই। এসব ভাবতে ভাবতে আদৃজার মনে একটা সন্দেহের কাঁটা বিঁধতে লাগল। সাথে সাথে রাগটাও বাড়তে শুরু করে। ৩০ মিনিট ব্যাস্ত থাকার পর আদিল কলব্যাক করলো। 

—হ্যালো.. 
—হ্যালো মানে!! কোথায় ব্যস্ত ছিলিস এতো রাতে? কার সাথে ব্যস্ত ছিলিস? 

প্রচন্ড রেগে গিয়ে একটানা প্রশ্ন করতে শুরু করে দিলো আদৃজা। প্রশ্নগুলো শুনছে ঠিকই কিন্তু উত্তর দেওয়ার কোনো সুযোগ পাচ্ছে না আদিল। আর যখন নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার সুযোগ আসলো তখন আর সেটা আদৃজার কাছে বিশ্বাসযোগ্য হল না। 

— "আগে থেকেই তোর উপর সন্দেহ ছিল। এখন আমি নিশ্চিত, তাই আমাদের বিয়ে ভুলে যা। যদি সত্যিই আমাকে ভালোবেসে থাকিস তাহলে বাড়িতে বলে দিস যে এই বিয়ে করছিস না। যদি আসিস তাহলে আমার মরা মুখ দেখবি।" 

শেষ কথাটা বলেই কলটা কেটে দিয়েছিলো আদৃজা। এরকম একটা ছোট্ট কথার জন্য সম্পর্ক নষ্ট? এটা সম্ভব? আদিল জানে আদৃজা কথায় কথায় খুব রেগে যায়। কিন্তু সেই রাগের জন্য কী বিয়ে ভাঙা যায়? আদিল বুঝতে পারলো না কি করবে। অনেকবার কল করার চেষ্টা করল আদৃজাকে। কিন্তু প্রতিবারই ওর কলটা কেটে দিচ্ছিল আদৃজা। এরকম কিছুক্ষণ চলার পর একটি মেসেজ এলো, অদৃজার। তাতে লেখা ছিল, "আর কোনোদিন যোগাযোগ করবিনা, তাহলে আমাকে আর কেউই দেখতে পাবে না কোনোদিনও।" 

           এরপর আদিলের আর সাহস হলো না আদৃজাকে যোগাযোগ করার। কারণ সে জানতো আদৃজা সেটা করে যেটা সে বলে। কিনতু এত সহজে তাদের সম্পর্কের ভাঙ্গন মেনে নিতে পারলো না আদিল। যদি আদৃজা একবার শুনতো ওর কথা, যদি আদৃজা একবার ওকে বিশ্বাস করত যে বিয়ের আগের রাতে নেহাতই ওর কিছু বন্ধুদের সাথে হাসি-মজা করছিল... এরকম অনেক যদি-র নিচে চাপা পড়ে গেছিল ওর মনের কান্না। কিনতু সেই মুহূর্তে সুইসাইডের হুমকি দেওয়া একগুঁয়ে আদৃজার থেকে দূরে চলে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না আদিলের কাছে। এরপর আদিল পুরোপুরি ভেঙে পড়ে, আর থাকতে চায়নি এখানে। পুরোনো স্মৃতি ভুলতে কিছুদিনের মধ্যেই রওনা হলো আমেরিকা। আদিল আগেই ওখানে জব অফার পেয়েছিলো। কথা ছিলো বিয়ের পর আদৃজাকে নিয়েই বিদেশ পাড়ি দেবে, কিনতু তখন আদৃজাকে ভুলে থাকতে দেশ ছেড়েছিল। 

একটা বাচ্চার আওয়াজে চমক ভাঙল আদিলের। জিজ্ঞাসা করল, "কোথা থেকে ফিরছিস?" 

— আমি তো দিল্লি থেকেই কলকাতা যাচ্ছি। তুই ? 
— যেখানে গিয়েছিলাম সব ছেড়ে সেখান থেকে ফিরছি, আমেরিকা থেকে। আজ ৮ বছর পর। দিল্লিতে নেমে আবার কলকাতার ফ্লাইট। কিন্তু এই পুচকেটা কে? 
— আমার ছেলে দুদিন পর ওর জন্মদিন, তাই কলকাতা ফিরছি। 
— তার মানে তুই দিল্লীতেই থাকিস? তা তোর হাজব্যান্ড কোথায়? 
আদৃজা কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল। 
— কী হলো? চুপ করে গেলি যে!! 

আদৃজা তবু চুপ করেই রইল। শুধু আদিল দেখল আদৃজার চোখের কোণ বেয়ে জল পড়তে লাগল। তারপর খেয়াল করলো আদৃজার হাতে শাখা-নোয়া বা মাথায় সিঁদুর নেই। 

"মানে ........" কিছু বলতেই যাচ্ছিল আদিল। হঠাৎ ওকে থামিয়ে আদৃজা বলে উঠল, 

— আমাদের সম্পর্কটা ভেঙে যাওয়ার পর তুই চলে যাস। তার কিছুদিন পর আমি খুঁজেছিলাম তোকে কিন্তু ততদিনে তুই চলে গেছিস। কোথায় গেছিস তোর বাড়ির কেউ বলেনি আমাকে। তারপর বাড়ি থেকে বিয়ে দিয়ে দেয় দিল্লির একজন ব্যাবসায়ীর সাথে। বছর দুই আগে একটি কার একসিডেন্টে মারা যায় আমার হাজব্যান্ড। তারপর থেকে ব্যবসা, সংসার,ছেলে সব আমাকেই সামলাতে হয়। 

— আমার আদৃজার ওপর দিয়ে যে এত ঝড় বয়ে গেছে সেটা ভাবতেও পারছি না। যেমন সেদিন ওরকম একটা ছোট্ট কারণে আমাদের সম্পর্কটাকে ভেঙে ফেলবি সেটাও কখনো কল্পনা করিনি। সেদিন আমি ফোনে ব্যাস্ত ছিলাম ঠিকই, কিনতু আমার এক বন্ধু নিজেদের মধ্যে সামান্য ঝগড়া নিয়ে সুসাইড করতে যাচ্ছিল। সেই মুহূর্তে ওকে বোঝানোটাই সবচেয়ে বেশি গুরুতূপূর্ণ বলে মনে হয়েছিল আমার। তখন মনে মনে নিজেকে খুব লাকি মনে হচ্ছিল আমার, যে আমাদের মধ্যে ঝগড়া হলেও আমরা মানিয়ে নিতে পারি। কারণ আমার কাছে তুই আছিস। কিন্তু তুই তো আমাকে কিছু বলার সুযোগই দিলি না। একবার ভাবলিও না যে এভাবে সম্পর্ক ভাঙ্গলে আমার কী হবে। 

— তোকে বলার সুযোগ দিলেও সম্পর্কটা আমাদের ভাঙতোই রে। আর তখন যে আমি নিজেকে.... 

— মানে ? 

"প্লিজ গিভ ইওর কাইন্ড অ্যাটেনশন, ফ্লাইট উইল ল্যান্ড উইদিন ফাইভ মিনিটস, কাইন্ডলি চেক ইওর সিটবেল্ট" 

— মনে, আমার নাম আদৃজা মুখার্জী আর তোর নাম মোহাম্মদ আদিল শেখ। আমার বাড়িতে একটানা অস্বীকার করার পর হঠাৎ আমাদের সম্পর্কটা সবাই মেনে নিয়েছিল ভালোভাবেই। তাতে একটু অবাক হয়েছিলাম প্রথমে কিন্তু পরে ভেবেছিলাম সত্যিই মেনে নিয়েছে। তখন তো বুঝিনি তোকে মেনে নেওয়ার উদ্দেশ্যে ছিল তোকে খুন করা আর তোর নামে মিথ্যে বদনাম দিয়ে আমার মন থেকে তোকে সরিয়ে ফেলা। 

আদিল বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রয়েছে আদৃজার দিকে। আদৃজা বলে চলেছে, "সেদিন হাতে মেহেন্দি লাগিয়ে খুব খুশি ছিলাম আমি। দৌড়ে ছাদে যাচ্ছিলাম তোকে মেহেন্দির ছবি দেখাবো বলে। হঠাৎ বাবার ঘর থেকে কয়েকজনের চাপা কথার আওয়াজ শুনতে পেলাম। কোনো প্রবলেম হয়েছে ভেবে ঘরে ঢুকতে গিয়ে বুঝলাম দরজা বন্ধ। তখনই সব শুনেছিলাম। তখনই তোকে কল করছিলাম। কিনতু তুই ব্যস্ত ছিলিস। আর সেই সুযোগটাকেই আমি কাজে লাগালাম। কারণ সত্যি কথা বললেও হয়ত তুই আমাকেবিয়ে করতে চলেই আসতিস। ভেবেছিলাম কিছুদিন পর বাড়ি থেকে লুকিয়ে তোর কাছে যাব। কিনতু ততদিনে তো তুই চলে গেছিস। 

          আদিল তখন পুরোপুরি বিধ্বস্ত। সেদিনের পর থেকে ও আদৃজার ওপর কত রাগ করেছে, বিরক্ত হয়েছে। শেষের দিকে নিজের সমস্ত দুঃখের জন্য আদৃজাকেই দায়ী করেছে আর ওকে অ্যাভয়েড করে ভুলতে চেয়েছে। আজকে দুজনের দেখা হওয়ার একটু আগে অবধি আদিল ভাবত আদৃজা ওর লাইফটা শেষ করে দিয়েছে। কিনতু আদৃজা তো ওকে পুরো জীবনটাই দান করে গেল। এতদিন ও শুধু নিজের পাওয়া-না পাওয়ার হিসেব কষত। কিনতু আজ জানলো আদৃজা পুরোটাই ওকে দিয়ে গেছে, বদলে চায়নি কিছুই। 

— এক্সকিউজ মি স্যার ...ফ্লাইট ল্যান্ড করে গেছে। 

এয়ার হোস্টেসের ডাক শুনে ঘোর কাটল আদিলের। দেখলো পাশে আদৃজা নেই... সবাই বেরিয়ে গেছে। দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এসে ডাকল, "আদৃজাআআ....!!!" আদৃজা ফিরে তাকিয়ে মৃদু হাসতে হাসতে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানালো আদিলকে। আদিলও দূর থেকে হাত নেড়ে বিদায় জানালো। এখন আর ওর মনে কোনো খারাপ লাগা নেই। কারণ ও জানে আদৃজাকে জীবনে না পেলেও আদৃজার অদৃশ্য ভালোবাসা ওকে আজও আগলে রেখেছে।


                                                ©  মনোজ রায় ©

" তনুশ্রী " - এম.কবির


         পুরুত মশাই মন্ত্র পাঠ করছেন। তনুশ্রী কনে সেজে বসে আছে। এইবার উঠতে হবে, সাত পাক ঘুরতে হবে তাকে। কার সাথে- যাকে সে চেনেনা, যাকে সে বোঝেনা। কি ভাগ্যের পরিহাস, তাই না? আর যাকে চেনে, বোঝে সে একটু দূরে পিছন থেকে করুণ নয়নে চেয়ে চেয়ে তাকাচ্ছে, হাসছে, কাঁদছে, লুকিয়ে লুকিয়ে চোখের জল মুচছে। হা হা হা। অরুণ তেমন হ্যান্ডস্যাম নয়, ছিমছাম চেহেরার একটা ছেলে। আজ তার উপর প্রচুর দায়িত্ব। মেসোমশায় মানে তনুর বাবা তাকে এই বিয়ের সব দায়িত্ব দিয়েছে না!! বাড়ীর বড়রা সবাই ফুল ছিটাচ্ছে,পুরুত মশাই মন্ত্র পাঠ করছেন। অরুণের কানে আজ মন্ত্রগুলো যেন বিঁধছে। উলুর আওয়াজ তার বুকে আঘাত দিচ্ছে যেন। তনু মানে ওই তনুশ্রী এক পা দু পা করে পাক দিচ্ছে। মন চায়না, পা দুটো যেন জোড়হাত করছে, কাকুতি-মিনতি করছে। তনু কাঁদছে। সবার চোখে তার এই কান্না হয়ত বাপের বাড়ি ছাড়ার কান্না। কিন্তু জানে শুধু দুজনা। তারা... হ্যা শুধু তারা।



                                                © এম.কবির ©

"আশীর্বাদী" - সুফি রায়





— তোমার আমাকে কিছু বোঝাতে হবে না বৌদি। আমার স্বামীকে আমি চিনি। 
— কোনো মেয়ে নিজের সম্মানহানির কথা বানিয়ে বলে না শর্বরী। 
— আমার দাদা নেই বলে বেলেল্লাপানা করতে শুরু করে দিয়েছ?? ছি ছি!! কিনতু তোমার মত এমন কুহকিনী মেয়েমানুষ বললেই তো আর আমার এমন দেবতার মত স্বামীর চরিত্রে কলঙ্ক লেগে যাবে না!! 
— আমারই ভুল ছিল শর্বরী, ক্ষমা করো। পাপ তো জীবনে অনেক করেছি, তার শাস্তিই হয়ত পাচ্ছি। কিনতু জীবনে যদি কোনো পুণ্য করে থাকি, তবে আমার সমস্ত পুণ্য একত্র করে তোমাকে আশীর্বাদ করছি... তোমার ছেলেও যেন বড়ো হয়ে ওর বাবার মতো হয়।


                                                               
                                                    © সুফি রায় ©

"রাজপুত্তুর ও রাধিকা" - সঙ্ঘমিত্রা প্রামাণিক চ্যাটার্জ্জী



রাজপুত্তুর, দূরের থেকেই দেখবি রাধিকাকে?
রাধিকা যে হৃদমাঝারে তোর সঙ্গেই থাকে।
আলতো করে আঙুল ছুঁবি আপাদমস্তক?
আমার পাতা লুকিয়ে দেখিস? তুই দুষ্টু লোক।
সোজা কথা হারিয়ে গেছে ধরেছি কবিতা ছুতো।
তোকে দেখে আগের মতোই ভীষণই আপ্লুত।



  © সঙ্ঘমিত্রা প্রামাণিক চ্যাটার্জ্জী ©

"উত্তরণ" - শিল্পী মণ্ডল



বছর শেষে বছর আসে নতুন আলোর সাজে,
আবার শুরু হিসাব কষা চাওয়া পাওয়ার মাঝে।
কি হারালাম, কি বা পেলাম অংক মেলা ভার,
রঙিন স্বপ্ন সাজিয়ে দেব জীবন তরী পার।
নতুন আশায় সঞ্চারিত করব আবার প্রাণ,
নতুন সুরে বাঁধব আবার জীবনপুরের গান॥



                   © শিল্পী মণ্ডল ©

"কবিতার অপেক্ষায়" - রণবীর বন্দ্যোপাধ্যায়

তোমার সাথে যখন বলি একটুখানি কথা
কবিতা আসে, কোথা থেকে আসে ভাষাগুলো—
ভাষারাই শুধু জানে আমার ভাষার মানে,
কে যেন উঁকি দেয়, তোমারই মতো করে
মনে আচমকা, দমকা হাওয়া উত্তর কোণ
থেকে শিরশির করা পরশ আনে— কবিতার॥

এখন কার্তিকের হিমেল রাত—
তোমার উষ্ণতা কবিতায় স্পর্শ করে
আমার শরীর; অমাবস্যার আকাশ
সঙ্গী, কবিতা নিয়ে একা অন্ধকারে ;
এখন ঝিরঝিরে হাওয়া উত্তরের,
আর নিঃশব্দ শব্দের সপ্রেম উচ্চারণ—
সৃষ্টি কবিতার আমার অদ্ভূত নিস্তব্ধতায়,
অন্তহীন প্রতীক্ষার অবসান কবিতায়॥                                                                    
     © রণবীর বন্দ্যোপাধ্যায় ©

শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১৯

" দেওয়াল লিখন " - অভিষেক ঘোষ



হাত তুললে হাত,
পা তুললে পা,
ভুখা হরতালে মশলা মুড়ি
অথবা প্রচন্ড শীতে খালি গা।
অস্ফুট চীৎকারে হাততালি
বা স্তুতিগানের ফুলঝুরি,
দলে আছো খোকা..
তবেই না আমাদের মতো তুমি,
কাল ফাঁকা চেয়ারের উত্তরসূরি।
বা বা বেশ, যা বলছি শোনো...
নিয়ম, হ্যাঁ হ্যাঁ যেগুলো বলেছি,
মাথায় পেরেক মেরে ঢোকাও
শুধু সেগুলিই নিয়ম..
এই যে ক্ষুধার্ত তরুণ আমাদের অমুক দলে
অমুক গ্রুপে আছো তো,
হ্যাঁ হ্যাঁ মেনে চলো চলো....
তন্ত্র নামক যন্ত্রটা দিন দিন রূপসী হচ্ছে
বিভিন্ন নামে।
আসলে সত্যিটা হল জন ছাড়া দল মৃত।


                                                           
   © অভিষেক ঘোষ ©

বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১৯

" কবিতা " - অরুণোদয় ভট্টাচার্য


কারো স্মৃতি ম্লান ফুলে 
কারো কোন ফলকে— 
কারো কথা মন ভোলে 
দু চোখের পলকে ! 

তোমার সামনে আমি 
তবু তুমি কী উদাস! 
মেঘ-ছায়া ভাসে চোখে, 
কেন হোলে দেবদাস? 

সংগীতে ভরে মন, 
স্মৃতিপথ ধরে ধায়— 
কত সম্পর্কের 
ভাঙা-গড়া ছুঁয়ে যায় !


  © অরুণোদয় ভট্টাচার্য ©

বুধবার, ২ অক্টোবর, ২০১৯

সত্যের চাবিকাঠি - সম্পূর্ণ গল্প

পত্রিকার জন্মদিনে পত্রিকার তরফ থেকে আপনাদের জন্য রইল রিটার্ন গিফ্ট। একটি সম্পূর্ণ গোয়েন্দা কাহিনী একটি ফাইলে।



শ্যামবাজারের অবস্থাপন্ন বনেদী বাড়িতে তপন কুমার দে নামে ভাড়াটিয়া খুন। পুলিশ তদন্তে নেমে জানতে পারে তপন কুমার দে দু'বছর আগেই মারা গেছেন। তবে খুন হওয়া এই ব্যক্তি কে? এমনকি তার স্ত্রী পরিচয়ে থাকা, খুনের পরে পলাতক মহিলাও তার আসল স্ত্রী নন। এদিকে বাড়িওয়ালা সুকুমার সেন পুলিশি জেরায় জেরবার। প্রশ্ন অনেক। খুনি কে? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন ভিক্টিম কে? সে কেন অন্য লোকের পরিচয়ে বাড়ি ভাড়া নিয়েছিল? খুন হওয়া ব্যক্তি কি নিজে অপরাধী? নাকি অপরাধের শিকার? উত্তর খুঁজতে হলে সঙ্গী হতে হবে সত্যের অভিযানের। সঙ্গে থাকুক "সত্যের চাবিকাঠি"।



রবিবার, ১৯ মে, ২০১৯

" পুনরাবর্তন " | শিল্পী মণ্ডল


ওই শোনা যায়, ধর্মের  অট্টহাসির শব্দ ...
দুই দলের খেলায় আবার মানুষ হচ্ছে জব্দ।
মানুষে মানুষে হানাহানি, আর সেই চিরস্থায়ী দ্বন্দ্ব।
ধর্ম আজও সেই সাম্প্রদায়িকতার মুখ্য প্রতিবন্ধ॥
ধর্ম আর রাজনীতির সেই পুরাতন ঘৃণ্য সন্ধি, 
মানবিকতা হয় যেখানে নিঃশব্দে বন্দি।
ধর্মের নামে মানুষ খুনের চরম নির্মম সত্য
আজও যেন সেই রক্ত ঝড়ানো ইতিহাস অনবদ্য।
ইতিহাস আজ আবার জেগেছে নৃশংসতার ছোঁয়ায়...... 
মানবিকতা ঢাকছে আবার ধর্মের অন্ধ মায়ায়॥


                                                                                              
                                         শিল্পী মণ্ডল ©

" ইচ্ছে " | অক্ষয় মণ্ডল


মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে, পাখি হয়ে যাই।
পাখিদের কত মজা, জানি আমরা সবাই II
এখন আমি আকাশটাকে, দেখি চেয়ে চেয়ে।
পাখি হলে বলতাম কথা, তার সাথে গিয়ে॥
হতাম আমি বন্য পাখি, ঘুরতাম নানা দেশ।
গাছেদের সাথে আমি বলতাম কথা বেশ॥
পাখি হয়ে আকাশেতে দিতাম আমি পাড়ি।
পাড়ি দিয়ে যেতাম আমি মেঘেদের বাড়ি॥
দেখতাম চেয়ে মেঘগুলো সব ওড়ে কেমন করে।
উড়তাম আমি সারাটা দিন মস্ত আকাশ জুড়ে॥
কিন্তু যদি পড়ি ধরা কোনো শিকারির ফাঁদে।
জীবন আমার হবে বৃথা, মরব কেঁদে কেঁদেII
এই কথা ভাবি যখন, বড়ই কষ্ট হয়।
পাখি হওয়ার ইচ্ছে আমার, ধুলোয় মিশে যায়॥


                                                                                        
                                  অক্ষয় মণ্ডল ©

বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০১৯

" শিক্ষক " | ধ্রুব বিকাশ মাইতি


চলিত এই দিনে
জাগছে মনে প্রাণে...
শিক্ষক মানে সৃষ্টিকর্তা মোদের সবার,
সুন্দর জীবন
সাধ্যের জোরে করেন গঠন,
শিক্ষা সংগ্রামে লড়ছি মোরা হতে তাঁদের মতন।
শিক্ষক মানে বাবার আদর...
দেখান ওনার পরিচালনার কদর,
শিক্ষক মানে শীতের চাদর গরমের জন্য বাতাস;
ওনার সব সাধু আচার 
বাড়ায় মোদের বিশ্বাস।
শিক্ষক মানে সাজানো সমাজ
বন্ধুর মতো সাথি
ওনাদের দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে কত রথী-মহারথী।
শিক্ষক মানে শিক্ষা গুরু, মানুষ তৈরীর কারিগর
উনি ব্রহ্মা উনি বিষ্ণু উনি মহেশ্বর।
শিক্ষক মানে আদর্শ,
সর্ব কর্মনিষ্ঠা, জ্ঞান, মান—
শিক্ষক মানে দায়িত্ব পালনের অনন্য অভিধান।
শিক্ষক মানে সুখের ছায়া—
শিক্ষক মাানে তৃপ্তি,
সমস্যাদের সমাধান আর
পথ চলার গতি।


                                                                                                 
                                           ধ্রুব বিকাশ মাইতি ©

" জীবনপণ " | আবুল হাসেম



ভাবনাশক্তির প্রখরতাই আমি দর্শন পেয়েছি সেই জগৎ,
যা সবার দৃষ্টির অগোচর।
কল্পনাময় জগৎ থেকে তাকে বাস্তবে টেনে আনবোই আপন শক্তিতে।
মানব মনের পশুত্বকে বশ করবো আপন ভাবনা শক্তির তীব্র প্রভাবে।
নবজাতকের অবতারে প্রবেশ করাবো আপন চিন্তন শক্তি।
মানবের অন্তরে লিপিবদ্ধ করবো আপন ভাষা। 
তাদের মুখের ভাষাই আমার প্রাপ্তি
দেবে গতি আপন পথের ধারায়।
সেই ভাবনাতেই জাগ্রত চিত্তে রয়েছি সদা।


                                                                                                   
                                           আবুল  হাসেম ©

নীরব আলো MAY 2019 - PDF ডাউনলোড




নীরব আলো -  মে ২০১৯ " - একটি ছোট্ট এবং সম্পূর্ণ স্বাধীন প্রচেষ্টা আপনাদের মনোভাব সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়ার | আপনাদের মধ্য থেকেই  লিখিত সংগ্রহকে এই পত্রিকার মাধ্যমে প্রকাশিত করা হয় প্রতি মাসে |

পত্রিকাটি কোন রকম ব্যবসায়ীক ক্ষেত্রে ব্যবহিত করার জন্য নয় | এটি একটি সম্পূর্ণ বিনামূল্যের মাসিক ই-পত্রিকা |

" নীরব আলো "মে ২০১৯ সংখ্যা প্রকাশিত হল আপনাদের জন্য  |  ডাউনলোড করুন ,পড়ুন ,আনন্দ উপভোগ করুন এবং এর সাথে নিচে কমেন্ট বাক্স এ আপনাদের মতামত ,অভিযোগ অবসায় জানাবেন  | আপনাদের মতামত নতুন লেখক লেখিকাদের আরো উৎসাহিত করবে  |

আপনারা সকলেই আমাদের মাসিক ই-পত্রিকাটি PDF ফাইল ফরম্যাট এ ডাউনলোড করতে পারবেন নিচের লিঙ্ক টিতে ক্লিক করে  | "ডাউনলোড" বোতামটিতে ক্লিক করলেই ডাউনলোড শুরু হয়ে যাবে | ধন্যবাদ


মঙ্গলবার, ৭ মে, ২০১৯

" স্বপ্নপূরণ " - দ্বিতীয় খন্ড | অস্মি সেনগুপ্ত


               লেখার পরেই অপর্ণার মধ্যে একটা যেন বিদ্যুতের তরঙ্গ বয়ে গেল। কিছুটা অজানাকে জানার কৌতূহল, কিছুটা নতুন কিছুর সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ভয় তার মনকে বার বার নাড়া দিয়ে তুলছিলো।
যথাসময়ে মিঃ বোস বাড়িতে এসে উপস্থিত। আলাপচারিতা শেষে শুরু হলো অপর্ণার ট্রেনিং। প্রথমে শুরু হলো ইংরেজিতে অনর্গল কিভাবে কথা বলতে হয় তার ট্রেনিং। অপর্ণা ইংরেজি ভাষাটা জানলেও ইংরেজিতে কথা বলতে একটু ভয় পায়। আসলে ছোটবেলায় একবার স্কুলে ইংরেজিতে কথা বলার সময় একটু ভুল বলায় তাকে নিয়ে তার বন্ধুরা খুব হাসাহাসি করেছিল। তার পর থেকেই ইংরেজিতে কথা বলার ভয়টা তার মনের মধ্যে বেশ জমিয়ে বাসা বেঁধেছে। এতদিন পর তার মনের মধ্য থেকে সেই ভয়ের বাসা ভেঙে ভয়কে উচ্ছেদ করা যাবে কিনা সেটা নিয়েই হাজার রকম ভাবনা কাজ করেছে অপর্ণার মধ্যে। এতক্ষণ তবু প্রতুল পাশে বসে থাকায় মনে একটু সাহস জুগিয়ে শেখার চেষ্টা করছিল সে। কিন্তু হঠাৎ একটা ফোন আসার পর তাড়াহুড়ো করে প্রতুলের বেড়িয়ে যাওয়ার পর অপর্ণার মনের ভয়টা যেন আরও শক্ত করে নিজের বাসখানা গুছিয়ে নিল। এই মুহূর্তে প্রতুলের তো ওর সাথেই থাকার কথা। কিন্তু এইভাবে ওকে একা ফেলে চলে চাওয়াটা যেন মেনে নিতে পারছেনা অপর্ণা। মোটের ওপর সেদিন সে তেমন কিছুই শিখতে পারলো না। যতটা আশা নিয়ে তার দিনের শুরু হয়েছিলো ততটাই নিরাশার সাথে দিনটা শেষ হলো। তাই ওদিকে ভরে উঠল তার ডায়েরির পাতা-
লেখাতে আজ নেই তো মন,
খাতা কলমও ছিঁড়েছে বাঁধন,
তুই এসে বলবি কখন-
"চিন্তা নেই, আমি আছি তো সারাক্ষণ"।

তার পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে প্রতুল পাশে নেই ,বালিশের ওপর একটা ছোট চিঠিতে লেখা-"অফিসের কাজে একসপ্তাহের জন্য পাটনা যাচ্ছি।নিজের খেয়াল রেখো"। চিঠিটা পড়েই অভিমানের পাহাড় তৈরি হলো অপর্ণার মনে।এইভাবে একটা ছোট চিঠি লিখে চলে গেল, একবার তাকে মুখ ফুটে বলে উচিত ছিল।বিছানা ছেড়ে তৈরি হয়ে নেয় ট্রেনিং এর ক্লাসের জন্য।কিন্তু মনটা সারাক্ষন প্রতুলের দিকেই পরে থাকে আর বার বার ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে প্রতুলের কল বা মেসেজ এলো কিনা।এদিকের বিকালের দিকে হঠাৎ কালো মেঘ জমে  প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়।যেন অপর্ণার কষ্ট প্রকৃতিও বুঝতে পারছে তাই সেও অপর্ণার দুঃখে নিজের চোখের জলকে বৃষ্টি হিসাবে ঝরিয়ে দিচ্ছে।অপর্না তার  নিত্য সঙ্গী ডায়রি খুলে লিখতে শুরু করে-
"বৃষ্টি মাখা সন্ধ্যা জুড়ে মনে পড়ে তোমায় সারাক্ষন,
অপেক্ষায় থাকি,কখন তোমার আসবে টেলিফোন?"

এইভাবেই একটা একটা করে দিন কাটতে থাকে আর অপর্ণার মনের মধ্যে ভয়ের সাথে হতাশা বন্ধুত্ব পাতিয়ে তাদের বাসা শক্ত করে। এখন ইংরেজি শিক্ষার সাথে উচ্চ সমাজে কিভাবে মিশতে হয় তার প্রশিক্ষণও চলছে। ধীরে ধীরে অপর্ণা আর প্রতুলের সম্পর্কের মধ্যে দুরত্ব বেড়েই চলেছে। অপর্ণার প্রতি প্রতুলের কেয়ারিং ভাবটা যে অনেকটাই কমে গেছে সেটা সে ভালোই বুঝতে পারে। এদিকে অপর্ণার খাবারের তালিকায় পরিবর্তন হয়েছে।এখন যা খেতে ইচ্ছা করে কিছুই পায়না তার পরিবর্তে কি সব খেতে দেয় যেগুলো সে আগে কখনো চোখেই দেখেনি,তাতে তার না ভরে পেট আর না ভরে মন। সে ভাবলো তার প্রতি কেয়ারিং ভাবটা হয়তো প্রথম প্রথমই ছিল। কিন্তু মুখ ফুটে সে কিছুই বলতে পারে না।তার মনের কথার একমাত্র সাক্ষী তার ডায়রি।মনের যত মান,অভিমান, কষ্ট ,সুখ দুঃখের গল্প সব ডায়রির পাতা জুড়ে ভর্তি।ডায়রিতে সে প্রায় প্রতিদিন লেখে তার অভিমানের কথা―

"মান অভিমানের চলছে রেশ ,
কোথাও বা সময় শেষ ,
স্বপ্নের বাড়িতে ধূলো জমছে, 
নীরবে মোমবাতি তার প্রহর গুনছে।"

এইভাবেই রেল লাইনের মতো পাশপাশি থেকেও  সামন্তরাল ভাবে চলতে থাকে তাদের বিবাহিত জীবন।ছয় মাস কেটে গেল তবু কোনো কিছুই অপর্ণা শিখে উঠতে পারলো না। কিছু শিখতে না পারার কষ্ট তাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলেছে। শাঁখের করাতের মতো অপর্ণার জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠছে। না পারছে এগিয়ে যেতে আর না পারছে এসব থেকে পিছিয়ে আসতে। যদিও সে একদিন নিজেই চেয়েছিল সমাজে এক বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে। কিন্তু এখন তার জীবন এই ট্রেনিং এর যাঁতাকলে পেষা হয়ে যাচ্ছে।আজ তার মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে।একমাত্র তার মা তার মনের কথা না বললেও ঠিক বুঝে যেত।দু চোখে জল নিয়ে ডায়রির পাতায় লিখতে শুরু করে-
"সম্পর্কের টানাপোড়েনে আমিও অবসন্ন,
সময়ের যাঁতাকলে স্মৃতিরাও আজ বিবর্ণ ।"

একদিন হঠাৎ প্রতুল এসে জানালো যে তাদের কোম্পানীর একটা কনফারেন্সের অনুষ্ঠানে অপর্ণাকে ইংরেজিতে একটি বক্তৃতা দিতে হবে। কথাটা শুনেই আঁতকে উঠল অপর্ণা। সে অনেকবার প্রতুলকে বোঝানোর চেষ্টা করলো যে সে পারবে না কিন্তু প্রতুল তার কথা শোনার পাত্র নয়।
অগত্যা পরের দিন অপর্ণাকে যেতেই হলো অনুষ্ঠানে কারণ তাকে বক্তৃতা দিতে হবে। কিন্তু সে কি বলবে সেটাই তার মাথায় আসছে না।
যথা সময়ে অপর্ণাকে মঞ্চে ডেকে মাইক দেওয়া হলো। একদিকে ইংরেজিতে কথা বলার ভয় আর অন্য দিকে এত মানুষজনকে দেখে সে এতটাই ঘাবড়ে গেল যে মুখ দিয়ে কোনো কথাই বের হয়নি। স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে রইল।
যখন তার হুঁশ ফিরলো মনে মনে খুব দুঃখ পেলো প্রতুলের জন্য। প্রতুল এত আশা নিয়ে ওকে মঞ্চে তুলেছিল, কিন্তু সে নিজের সাথে সাথে প্রতুলেরও মান সম্মান সব ডুবিয়ে দিলো।
বাড়িতে ফিরেই প্রতুল অপর্ণাকে পাশে বসিয়ে রীতিমত জেরা শুরু করলো।
―কি হয়েছে তোমার আজ মঞ্চে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে ছিলে কেনো?
―জানি না কেনো।
―কমপক্ষে দু একটা কথাও তো বলতে পারতে। বলোনি কেনো?
―জানি না।
― তোমার কি শরীর খারাপ?
― না।
এতক্ষণ প্রতুল শান্ত ভাবেই প্রশ্ন গুলো করছিলো। কিন্তু অপর্ণার এরকম উত্তর শুনে মাথায় আগুন যেন আগুন জ্বলছে। মেজাজ হারিয়ে উচ্চস্বরেই অপর্ণাকে কথা শোনাতে লাগলো।
―"জানো তোমার এই জানিনা কারণের জন্য আমার কতটা অসম্মান হলো। সে সম্পর্কে কোনো ধারণা আছে তোমার? গত ছয় মাস ধরে তোমাকে মিঃ বোস ট্রেনিং দিচ্ছেন। তুমি কি এতদিনে আমাদের কোম্পানি সম্পর্কে কিছুই বোঝোনি? তোমাকে উচ্চসামাজে কিভাবে মিশতে হয় সে সম্পর্কেও শেখানো হচ্ছে কিন্তু তুমি এতদিনে কিছুই শিখতে পারোনি। কার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় কিছুই শেখোনি।সেদিন তো খুব বড় মুখ করে বলেছিলে তুমি সব পারবে।কিন্তু এতদিনে এই সামান্য জিনিসটুকু শিখতে পারলে না।"
এতদিনে প্রতুলকে এতটা কোনোদিন রাগতে দেখেনি অপর্ণা। তাই আজ প্রতুলের প্রতিটা কথা যেন তার মনে তীরের মতো বিঁধছিল। তার অজান্তেই চোখের নোনাজল দুগাল বেয়ে বয়ে চলেছে।
"সাহিত্য আমার নেইকো জানা,
বুক জুড়ে শুধু অভিমান মেলে ডানা,
যখন বৃষ্টি হয়ে সে দুচোখ ঝরে-
তখনই মনের কলম মুখ খোলে।"

প্রতুলের মায়ের শরীর অসুস্থ থাকায় তিনি অনুষ্ঠানে যেতে পারেননি। কিন্তু প্রতুলের আওয়াজ শুনে প্রতুলের মা ঘটনার কিছুটা আন্দাজ আগেই পেয়েছেন। তাই কিছু বলবেন বলে দরজার কাছে গিয়ে আবার নিজের ঘরে ফিরে আসেন। কারণ তিনি জানেন তাঁর ছেলে যতটা শান্ত ঠিক ততটাই রাগী।একবার রেগে গেলে তাকে শান্ত করা খুব কঠিন।আবার খুব সহজে নরমও হয়ে যায়।
এদিকে প্রতুল অনর্গল বলেই চলেছে—
― তুমি যেদিন বলেছিলে তুমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাও, কিন্তু একটা সুযোগ চাই, তোমাকে সেই সুযোগটা দেওয়ার জন্যই তোমাকে বিয়েটা করেছিলাম। কারণ আমি আমার কোম্পানিকে বিশ্বের এক নম্বর কোম্পানি হিসাবে দেখতে চাই। আর আমার কোম্পানিকে প্রেজেন্ট করার জন্য চাই তোমার মতো একজনকে। আমার যে বিউটি প্রোডাক্টের কোম্পানি সেটা তো জানোই। আর এই কোম্পানির স্লোগান হলো "বয়স শুধুমাত্র একটা সংখ্যা। সৌন্দর্যতা সর্বদা বজায় রাখুন।" তুমি খুব সুন্দরী নও কিন্তু তোমাকে সুন্দরী করে বিশ্বের সামনে প্রতিস্থাপন করাই ছিল আমার লক্ষ্য। আর সেটা হলেই আমি আমার কাজে সফল হতাম। কিন্তু তুমি শুধু মুখেই বলো নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাও, আসলে তুমি কিছুই পারোনা। শুধু শুধু ছয়টা মাস নষ্ট করলে। জানো এই ছয় মাসে বাকি কোম্পানি কতটা এগিয়ে গেছে? তোমাকে আগেই বলেছিলাম কিছু পেতে গেলে কিছু হারাতে হয়।আর পরিশ্রম ছাড়া কিছু পাওয়া যায় না। সব কি ভুলে গেছো?
এতক্ষণে অপর্ণার চোখ দিয়ে জল পড়া বন্ধ হয়ে গেছে। যেন চোখের জল শেষ হয়ে গেছে। প্রথমে সে প্রতুলের রাগ দেখে কষ্ট পেলেও শেষের কথাগুলো শুনে স্তম্ভিত হয়ে কাঠের মতো নীরব হয়ে গেছে। কিন্তু মনের কোণে থাকা এতদিনের কষ্ট ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে অস্ফুট স্বরে বেড়িয়ে এল—
―"আমি শুধু তোমাকে পাশে চেয়েছিলাম। কিন্তু পাইনি।"
কথাটা শুনে প্রতুলের মন একটু নরম হলো। একটু হেসে বলল,
―এখনো তুমি সেই ছেলেমানুষই রয়ে গেলে। সশরীরে উপস্থিত থাকলেই পাশে থাকা হয় তা নয়, অন্য ভাবেও পাশে থাকা যায়।
―মানে?
―মানে এই যে গত ছয় মাসে তুমি নিজের মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখতে পাওনি?আগে বাড়ি ফিরে দেখতাম তুমি ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তে। বাড়ি ফিরে আমার ইচ্ছা করত তোমার সাথে একটু কথা বলতে। কিন্তু তুমি সশরীরে আমার পাশে থাকলেও তোমাকে আমার পাশে পাইনি। প্রথমে বুঝতাম না এটার কারণ কি। ভাবতাম আমাকে তোমার পছন্দ না তাই আমার সাথে কথা বলতে চাও না, তাই ঘুমিয়ে পড়তে। কিন্তু কিছুদিন পর বুঝলাম সারাদিন ট্রেনিং এর ক্লাস করে তুমি ক্লান্ত থাকো তাই ঘুমিয়ে পর। আর সকালে আমি কাজে বেরোনোর পর তুমি ঘুম থেকে ওঠো। তাই তোমার সাথে আমার সেভাবে কথা বলার সুযোগ হয়নি। নিউট্রিশনিস্টের পরামর্শে তোমার খাবারের তালিকার পরিবর্তন করা হয়েছে। মিঃ বোসকে বলে তোমার ট্রেনিং এর সময় কমিয়েছি। মাকে বারবার ফোন করে তোমার খবর নিয়েছি। অনেকবার ভেবেছি তুমি নিজে থেকে এসে বলবে আমি কেন তোমার খবর তোমার কাছ থেকে নিইনা। কিন্তু তুমি আমাকে কিছুই বলোনি।"

বাচ্চারা প্রথম হাতি দেখলে যেমন অবাক হয় অপর্ণা প্রতুলের কথাগুলো  অবাক হয়ে শুনছিলো।
ওদিকে প্রতুল বলেই চলেছে–
―তোমাকে বিয়ে করেছিলাম হয়তো শুধু নিজের স্বার্থে, কিন্তু ধীরে ধীরে কখন যে তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি নিজেই বুঝতে পারিনি। অন্যদের মতো ফুলের তোড়া নিয়ে হয়তো তোমাকে কোনোদিন মনের কথা বলতে পারিনি। কিনতু তার মানে এটা নয় যে তোমাকে ভালবাসিনা বা তোমার কথা ভাবিনা, তোমার পাশে নেই।শুধু মুখে ভালোবাসি বললেই কি ভালবাসা হয়?ভালোবাসতে গেলে সুন্দর মন লাগে যেটা তোমার আছে।"
―তুমি কি করে জানলে যে আমার সুন্দর মন আছে?
―যে এত সুন্দর লিখতে পারে তার মন সুন্দর না হয়ে পারে?
―মানে তুমি আমার ডায়রি লুকিয়ে পড়েছ?
―লুকিয়ে পড়তে যাবো কেন? সেদিন বাড়ি ফিরে দেখলাম ডায়রিটা পাশে রেখেই ঘুমাচ্ছিলে।হয়তো লিখতে লিখতে ঘুমিয়ে পড়েছিলে তাই ভাবলাম একটু পড়ি।
―তা কি পড়লে?
―আমাকে নিয়ে লেখা তোমার অভিমানের কথা।
তারপর প্রতুল ,অপর্ণার ডায়রির পাতায় লেখাগুলো পর পর বলতে থাকে-
"ভালো লাগে যখন তুমি সব কথাতেই লাগাও মাখন, 
মনের কোণে মেঘ জমেছে, কিছুটা প্রকাশ্য,কিছুটা একান্ত আপন।"

"দেখ তোর জন্য রোদ্দুর নামিয়ে পর্দা টাঙানো,
কোথাও মন নেই, সবচেয়ে দামি এই কথা জানানো।"

"তোমাকে নিয়ে দেখা স্বপ্নগুলো নিয়ে খুব বাঁচতে ইচ্ছা করে,
কিন্তু তুমি তো নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে ব্যস্ত।"

"চারিদিকে এখন প্রেমের মরশুম , 
আর আমি বুনছি বিরহের মাশরুম।"

"রাত্রি হলে নামলে আঁধার,তোমার শহর ব্যস্ত হয় আরো, 
তোমায় নিয়ে এত লিখি,একদিন ও কি পড়ো?"


"প্রেমের কথা  যতই বলি স্বপ্ন এখন অন্য, 
মিলব সেই একই জায়গায় রাস্তা যতই হোক ভিন্ন।"

"অভিমানের অভিযোগ নিয়ে তোমাকে আর দাঁড় করাবো না কাঠগড়ায়, ব্যর্থ আমি ,ভালোবেসে ও আজ আমি অসহায়।"

"খাতা কলম আজ গুনছে প্রহর,
কখন দু কলম লিখবো ভাবে, 
আমিও গড়েছি নিজের শহর ,
যেখানে এসে ভালোবেসে তুমি দুহাত বাড়াবে।"

"ভেবেছিলাম তুমি আর আমি লিখবো দু-এক অক্ষর,
এইভাবেই রেখে যাবো আমাদের প্রেমের স্বাক্ষর।"

প্রতুলের কথাগুলো অপর্না হাঁ করে শুনতে থাকে।মাত্র একবার পরেই প্রতুল তার লেখা গুলো মুখস্থ করে ফেলেছে অথচ সে নিজেই ভুলে গেছে সে তার ডায়রিতে কি লিখেছে।আসলে অপার্নার মনে যা আসে তাই ডায়রিতে লিখে রাখে কিন্তু সব মনে রাখতে পারে না।
প্রতুল বলতে থাকে-"এই যে ম্যাডাম, আপনি তো ভালোই লেখেন।কিন্তু ডায়রির পিছনের পাতা যদি একটু উল্টে দেখতেন তাহলে বুঝতে পারতেন আমার মনের কথা।"
সঙ্গে সঙ্গে অপর্না ডায়রিটা নিয়ে এসে দেখে ডায়রির পিছনের পাতায় লেখা আছে- 
"মন হওয়ায় পেয়েছি তোমার নাম,
জানি না কখন কেনো কিভাবে এতটা ভালবাসলাম।
মনি করে রেখেছি তোমায় চোখের তারায়, 
মনের কথা বুঝবে  কবে হায়!!" 

এখন নিজের ভুল ধারণা ভাঙতেই একটু লজ্জা পেয়ে অপর্ণা মাথাটা নামিয়ে নিলো। এখন নিজের কাছেই খুব ছোট লাগছে নিজেকে। কি যে বলবে কিছু বুঝতে পারছে না। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে আলতো গলায় বলল
―সরি, আমি সত্যি তোমার ভালোবাসা বুঝতে পারিনি। তোমার চাওয়াকে গুরুত্ব দিতে পারিনি। এবার থেকে শুধু আমার বা তোমার স্বপ্ন পূরণের জন্য নয়, আমাদের দুজনের স্বপ্ন পূরণের জন্য নিজেকে তৈরি করব, কথা দিলাম।
প্রতুল অপর্ণার হাত দুটো ধরে বলে উঠল― 
"জোনাকিদের আলো নিয়ে সাজাবো আমাদের ঘর;
অবহেলার ব্যাথা জমছে বুকে, এভাবে করে দিওনা পর।"

অপর্ণা প্রতুলের বুকে মুখ লুকালো।
*         *           *           *           *          *
এক বছর পর――― 
আজ অপর্ণা ইতালির কনফারেন্স হলে বক্তৃতা দেবে। এতদিন দেশেই কয়েকটা জায়গায় বক্তৃতা দিয়েছে এবং যথেষ্ট প্রশংসাও পেয়েছে। কিন্তু আজ বিদেশের মাটিতে প্রথম নিজের বক্তব্য রাখবে, নিজেদের কোম্পানির প্রোডাক্ট নিয়ে। নানা দেশ থেকে আসা গুণী মানুষজন তার কথা শুনবে। প্রথমে একটু ভয় করলেও প্রতুলের হাসি মুখটা দেখে সব ভয় চলে গেল। আসলে মঞ্চে উঠে মানুষজন দেখলেই অপর্ণার মনে যে ভয় ঘুরে বেড়াতো প্রতুলের হাসি সেই ভয়কে তাড়িয়ে দিতে সিদ্ধহস্ত।প্রতুলের হাসি তাকে এতটাই মুগ্ধ করে যে একসময় তার ডায়রিতে লিখেছিল-"ছোট্ট মনের আকাশমণি,ভিন্নতায় ছোঁয়ালো একফালি হাসি,আমি সেই হাসিতেই পোড়াতে চাই আমার সারাটা বেলা....""
বক্তৃতা শেষে পুরো হল হাততালির শব্দে ভরে গেল যেটার স্থায়িত্ব প্রায় পনেরো মিনিট। এটার পরেই অপর্ণার নাম বিশ্বের নানা দেশে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। অপর্ণার নামের মধ্য দিয়েই অপর্ণা আর প্রতুলের স্বপ্নপূরণ হলো।

দিনের শেষে অপর্ণা ফিরে আসে তার সারাজীবনের বন্ধু ডায়েরির কাছে। কলম নিয়ে লিখতে শুরু করে―
"বলেছিলে তোমার ঝাঁ চকচকে শহরে আমি অবাঞ্ছিত আগাছার মতো বেড়ে উঠেছিলাম, তাই তাকে কেটে ফেলা উচিত। ভাগ্গিস সেই ভুল সেদিন করোনি। নইলে আজ যে মানুষগুলো সেই আগাছা থেকে বেড়ে ওঠা মহীরুহের নীচে আশ্রয় খোঁজে তারা আশ্রয়হীন হয়ে যেত।" 



                                                                                                   
                                                   অস্মি সেনগুপ্ত ©
                                                       


                                                     =>> প্রথম খন্ড 

" স্বপ্নপূরণ " - প্রথম খন্ড | অস্মি সেনগুপ্ত



           পরীক্ষার জন্য অনেকদিন ডায়েরীতে কিছু লেখা হয়নি। আজ লিখতেই হবে, না হলে কোনো কাজে মন বসবে না...... এসব ভাবতে ভাবতে ডায়েরি আর পেনটা নিয়ে বসলো অপর্ণা। বসে কিছু না ভেবেই লিখতে শুরু করলো―
"রূপবতী নই তো আমি, নই তোমার স্বপ্নকুমারি, আমি তো এক কল্পবালা, নতুন পরিচয়েই তাই শুরু করলাম তোমার-আমার গল্পমালা।"
লেখা শেষ করে একবার লেখাটা পড়ে নিয়ে নিজের মনেই হাসলো আর ভাবলো, কিসের গল্প আর কার সাথেই বা গল্প— কি যে লেখে মাঝে মাঝে সে নিজেও জানে না।
অপর্ণার শখ, ইচ্ছা বলতে ওই ডায়েরি লেখা। যখন মনে যা আসে বা নতুন কিছু শিখলেও, সেটা রান্নার রেসিপি হোক বা মেকআপ এর কোনো টিপ্স(যদিও তার রান্না বা মেকআপ করতে অত কৌতূহল নেই), অথবা কোন বিশেষ কোনো ব্যক্তির উক্তি— সব সে তার ডায়েরিতে লিখে রাখে। তার বেস্ট ফ্রেন্ড বলতে তার ডায়রি। সে তার বেস্টফ্রেন্ডের নামও রেখেছে "স্বপ্নপরি"।
ডায়রি লেখা শেষ করেই মাকে খাবার দিতে বলে। যথারীতি তার কথা শেষ হতে না হতেই মা তার পছন্দের লুচি আর আলুর দম নিয়ে এসে হাজির।
― তুমি কী করে জানলে মা যে আজ আমার লুচি খেতে ইচ্ছা করছে?
― মেয়ের মনের কথা মা জানবে না তো কী পাড়াপড়শি জানতে আসবে?
― তুমি সত্যি খুব ভালো মা।
― হয়েছে হয়েছে। খাবার সময় অত কথা বলিস না। আগে খেয়ে নে।
― (খাওয়া শেষ করে) কী হলো মা, কিছু বলবে?
― হ্যাঁ, আসলে ঘটকমশায় এসেছিলেন। একটা খুব ভালো সম্বন্ধ এসেছে।
― মা আমি এখন বিয়ে করবো না।
― কেন? বয়স তো হলো তেইশ। আমাদেরও তো দায়িত্ব আছে।
― তাই বলে বিয়ে দিয়ে দেবে? আমি তো আগে একটা চাকরি করতে চাই।
― সে না হয় করবি। ওনারা আসতে চাইছেন, না করব কী করে? আর দেখতে এলেই তো বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না। লাখ কথায় বিয়ে হয়। আর তোর ইচ্ছার কথাটাও ওনাদের জানাস। যদি ওনারা আপত্তি না করে তাহলে ভালো আর আপত্তি করলে আমি ওরকম বাড়িতে আমার মেয়েকে পাঠাবো না।
― কিন্তু মা আমি তো ভালো রান্না করতে পারি না। যদি জিজ্ঞাসা করে কোন রান্নায় কী মশলা দিতে হয় আমি তো কিছুই বলতে পারবো না। ওনারা তখন তো আমার সাথে তোমাদেরকেও অপমান করবে যে মেয়েকে কিছুই শেখায়নি।
― দূর পাগলী মেয়ে সেই ভয়ে কি পাত্রপক্ষের কাছে বসবি না? আর ওনারা এক সপ্তাহ পর আসবেন। ততদিনে তোকে টুকিটাকি সব শিখিয়ে দেব। আর আমার মেয়ে রান্না না জানলেও বাকি যা গুণ আছে তাতে ঠিক পছন্দ করবে।
মা চলে যাওয়ার পর অপর্ণার হঠাৎ করে আজ ডায়রিতে লেখা কথাগুলো মনে পড়লো। তাহলে কি সত্যি ওর জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হলো নতুন গল্পের সাথে?

নির্ধারিত দিনেই পাত্রপক্ষ  অপর্ণাদের বাড়িতে উপস্থিত। পাত্রপক্ষ বলতে পাত্র নিজে, তার মা আর বাবা। আর কেউ আসেনি। পাত্রপক্ষ আসার আগেই অপর্ণা শাড়ি পরে সেজে রেডি। যদিও সে এই ক'দিনে রান্নার টুকিটাকি জিনিসগুলো মায়ের কাছ থেকে রপ্ত করে নিয়েছে। তাও তার মনের মধ্যে ভয়টা কিছুতেই যাচ্ছে না। যদি তারা এমন কিছু প্রশ্ন করেন যেটার উত্তর সে দিতে না পারে। আবার কিছুক্ষণ পরেই তার মনে হয় যে যদি উত্তর দিতে না পারে তো কি হবে? এটা কি কোনো বোর্ড এক্সাম যে সব প্রশ্নের উত্তর জানা বাধ্যতামূলক। কিন্তু উত্তর জানা না থাকলেও পাত্রপক্ষের  কাছে নিজের মূল্য কমাতে নারাজ সে। মনের মধ্যে এরকম নানা প্রশ্নোত্তরের টানাপোড়েনে সে নিজেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলো। সেই সময়েই পাশের ঘর থেকে শুনতে পেল পাত্রের মাকে বলতে-"কই এবার মেয়েকে নিয়ে আসুন।"
অপর্ণা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চায়ের ট্রেটা হাতে নিয়ে মায়ের সাথে বসার ঘরে গিয়ে উপস্থিত হলো। বড়দের প্রণাম সেরে পাত্রকে নমস্কার করে সবাইকে এক ঝলক দেখে নিয়ে বসলো। বসার পরেই তার নাম, কতদূর পড়াশোনা করেছে, কোথায় পড়াশোনা করেছে এসব টুকটাক প্রশ্নগুলো পাত্রের মা সেরে তার ছেলেকে ইঙ্গিত করে বললো ''এবার তোর কী জানার আছে জিজ্ঞাসা কর।"
এতক্ষণ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে অপর্ণার মনে একটু সাহস জন্মেছে। কিন্তু পাত্র আলাদা ভাবে কিছু জিজ্ঞাসা করবে শুনেই আবার তার ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। এত কিছুর মাঝে তো সে ভুলেই গেছে যে সে চাকরি করতে চায় সেটা পাত্রপক্ষকে জানাতে হবে।
― আমার নাম জানেন কিনা জানি না, তাও আর একবার বলছি। আমার নাম প্রতুল ঘোষাল। আমি বিজনেসম্যান। আমার নিজস্ব একটা কোম্পানি আছে। আমার একটাই প্রশ্ন তোমার জীবনের লক্ষ্য কী?

যে প্রশ্নটা স্বপ্নেও কল্পনা করেনি অপর্ণা, পাত্রপক্ষের কাছ থেকে সেটাই তাকে করা হচ্ছে। এটা স্বপ্ন না বাস্তব? আর এটার উত্তরটাই বা কী দেবে ভেবে উঠতে পারছে না। মা পাশ থেকে একটু কনুই দিয়ে ধাক্কা দিতেই মনে হলো এটা বাস্তব, স্বপ্ন নয়।
 কিছুটা আমতা আমতা করে বলতে শুরু করলো, "আসলে আমি চাকরি করতে চাই। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। এমন একটা জায়গায় যেতে চাই যেখানে সবাই যেন আমাকে এক নামে চিনতে পারে। পুরো পৃথিবী ঘুরে দেখতে চাই। মানুষের সাথে মিশতে চাই, তাদের নানান রকম মানসিক দিক বুঝতে চাই।
কথাগুলো বলে একটু দম নিলো অপর্ণা।
― কী চাকরি করতে চাও?
― সেটা এখনো ঠিক করিনি। সবে মাত্র পড়াশোনা শেষ করলাম।
― তোমার স্বপ্ন যদি আমি পূরণ করতে সাহায্য করি তাহলে তুমি কি আমার সঙ্গ দেবে?
কথাটা শুনতেই অপর্ণার চোখে মুখে আনন্দের ঝিলিক খেলে গেল। পরমুহূর্তেই কোথা থেকে একরাশ লজ্জা এসে ওকে রাঙিয়ে দিল। মাথা নিচু করে নিল অপর্ণা। ওর এই মৌনতাকেই সম্মতি ধরে নিয়ে দুই বাড়ি থেকে অপর্ণা আর প্রতুলের বিয়ে ঠিক হয়ে গেল পরের মাসেই।

একদিন বিকালে অপর্ণা আবার ডায়েরি খুলে পেনটা দাঁতের মাঝে নিয়ে ভাবতে থাকে, এইভাবে তাড়াহুড়ো করে বিয়েতে রাজি হয়ে যাওয়াটা কি ঠিক হলো?ছেলেটার সম্পর্কে আরো কিছু খোঁজ খবর নিলে হয়তো ভালো হতো। ছেলেটা কেমন বা তাকে হঠাৎ কেন এক দেখাতেই পছন্দ হয়ে গেল? সে তো অত সুন্দরী নয় যে তাকে এক দেখাতেই সবাই ওর প্রেমে পড়ে যাবে। তাহলে কি ওর চাকরি করতে চাওয়ার ইচ্ছার জন্য ওকে ভালো লেগেছে? ওর আর কী কী পছন্দ অপছন্দ কিছুই তো জিজ্ঞাসা করলো না। হাজারটা প্রশ্ন মনের মাঝে একসাথে ভিড় করে আসছে। শুধু উত্তরগুলো যেন কোথায় অদৃশ্য হয়ে আছে। এসব ভাবতে ভাবতেই অপর্ণা লিখতে শুরু করলো―
"মনের কথা জানলি বল তুই কেমনে,
খোঁজ কি নিস দুইবেলা আমার স্বপনে?
রাখিস যদি তারা করে তোর নয়নে
আঁকবো তোকে কাজল দিয়ে খুব যতনে।"

অপর্ণার যদিও ইচ্ছা একটা চাকরি করবে ,নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে কিন্তু আর পাঁচটা মেয়ের মতো ওর স্বপ্ন একটা ছোট সুখী সংসার হবে। অপর্ণার বাবা গ্রামের একটা প্রাইমারী স্কুলে চাকরি করতেন। তাই অল্প কিছু জমানো টাকা দিয়েই যতটা সম্ভব বিয়ের ব্যবস্থা করলেন। যদিও প্রতুলদের বাড়ির স্টেটাসের সাথে তাদের কোনো তুলনাই হয় না।

বিয়ের দিন যথারীতি সকাল থেকে বাড়িতে আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব সবাই এসে হাজির। বিয়ে উপলক্ষ্যে বাড়ির পরিবেশ একটু অন্য রকম হয়েছে। চারিদিকে ফুল দিয়ে সাজানো। সানাইয়ের সুরের সাথে আনন্দের বন্যা বইছে শুধু। অপর্ণা মনে মনে ঠিক যেমন ভেবেছিল সব সেরকমই চলছে।
যথাসময়ে অপর্ণাদের বাড়ির সামনে বিশাল একটা গাড়িতে করে বর এসে উপস্থিত। বর দেখে আসার পর কিছু আত্মীয় স্বজন নিজেদের মধ্যেই বলাবলি শুরু করলো, "বর যেমন দেখতে তেমনি বড়লোক। অপর্ণার কপাল আছে বলতে হবে।"
অপর্ণার বাবার সারাক্ষণ এই চিন্তাতেই কাটলো যে, অত বড়লোক বাড়ির লোকজন সব, তার এই যৎসামান্য আয়োজনে কি তারা খুশি হবে? তবে  শেষপর্যন্ত সব নিয়ম কানুন মেনেই সুষ্ঠ ভাবে বিয়েটা সম্পন্ন হলো। কনকাঞ্জলি দিয়ে বাবা-মাকে বিদায় জানিয়ে নতুন জীবনে শ্বশুরবাড়ির দিকে গমন করলো অপর্ণা। চোখে সব কিছু ছেড়ে আসার জলের সাথে হাজার স্বপ্ন নিয়ে হাজির হলো শ্বশুরবাড়িতে। তাদেরকে অভ্যর্থনার আয়োজন দেখে তো তার চক্ষু চড়কগাছ। সব কিছু তার কাছে স্বপ্নের মতো লাগছিলো যদিও এই স্বপ্নটা সে আগে কখনো দেখেনি। আচার অনুষ্ঠানের পর্ব সেরে নিজের ঘরে এসে তো আরো চমকে যায়। ঘরটার চারটি দেয়াল চার রকম। চারিদিকে রঙের খেলা। প্রয়োজনীয় প্রতিটা জিনিস খুব সুন্দর ভাবে সাজানো। অপর্ণা ভেবেছিল সে তার নতুন সংসার নিজের হাতে সাজাবে কিন্তু এখানে তো আগে থেকেই সব পরিপাটি করে সাজানো। এসব দেখতে দেখতে সে এতটাই মোহিত হয়ে গেছে যে প্রতুল কখন ঘরে এসেছে সে খেয়ালই করেনি।
― তোমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?
― না না।
― তোমার কিছু দরকার হলে শুধু একবার বলবে সব হাজির হয়ে যাবে।
― আচ্ছা বলবো।
― ঠিক আছে। কাল থেকে অনেক আচার অনুষ্ঠান পূরণ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছো নিশ্চয়ই। একটু বিশ্রাম করে নাও। কাল রাতে আবার বৌভাতের অনুষ্ঠান আছে।
― ঠিক আছে।
প্রতুল চলে যেতে একটু আরাম করে বিছানায় নিজের ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিতে দিতে ভাবলো, প্রতুলকে বাইরে থেকে বোঝাই যায়না যে মানুষটা এতটা  কেয়ারিং।
স্বপ্নের মতো কিভাবে যে একমাস কেটে গেল অপর্ণা বুঝতেই পারলোনা। ইতিমধ্যে তাদের সুইজারল্যান্ডে মধুচন্দ্রিমা সম্পন্ন হয়ে গেছে। তার জীবনে যেন এক নতুন ছন্দ সৃষ্টি হয়েছে। তবে তার সব থেকে যে কাজে ভয় ছিল সেটা তাকে করতেই হয়নি, সেটা হলো রান্না। বাড়িতে তো প্রতিটা কাজের জন্য আলাদা আলাদা কাজের লোক রয়েছে। তার যখন যেটা খেতে ইচ্ছা করতো শুধু মুখ ফুটে বললেই হাজির হয়ে যেত। এত ভালো একটা শ্বশুরবাড়ি এবং এত ভালো মানুষজন তার ভাগ্যে ছিল সেটা তার স্বপ্নেরও বাইরে। শ্বশুর, শ্বাশুড়ি, প্রতুল সবাই তাকে খুব ভালোবাসে, খুব যত্ন করে।

একদিন রাতে খাবার পর প্রতুল অপর্ণার হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে বলল
― তোমার এখানে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?
― অসুবিধা কিসের?আমার তো খুব ভালো লাগছে।
― ভালো তবে। তো তোমাকে যেদিন দেখতে গিয়েছিলাম তুমি তোমার স্বপ্নের কথা আমাকে জানিয়েছিলে মনে আছে?
― হ্যাঁ মনে আছে।
― তুমি কি এখনো সেই স্বপ্ন টা পূরণ করতে চাও?
― হ্যাঁ চাই। এমনিতে বাড়িতে তো সারাদিন বসে থাকি। কোনো কাজ করতেই হয় না। তুমিও বাড়িতে বেশি থাকোনা। যদি একটা চাকরি করতাম সময়টা কেটে যেত।
― ঠিক আছে। তার আগে তোমাকে অনেক কিছু শিখতে হবে। তারপর বলবো তোমার চাকরিটা কী।
― আচ্ছা কী শিখতে হবে?
― সব জানতে পারবে আস্তে আস্তে। কাল থেকে মিঃ বোস আসবেন, তিনি তোমাকে ট্রেনিং দেবেন। তুমি শুধু তার সাথে একটু সহযোগিতা করবে।
― অবশ্যই করবো।
― সব কিছুর আগে একটাই কথা বলে রাখি। সাফল্য কিন্তু এমনি এমনি আসেনা, অনেক পরিশ্রম করতে হবে। অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। মনে রেখো।
কথাগুলো অত না বুঝেই অপর্ণা বলল, "আমি পারবো। তুমি শুধু আমার পাশে থেকো।"
কথাটা বলেই অপর্না প্রতুল এর কাঁধে মাথাটা রাখলো। প্রতুলও অপর্ণাকে নিজের বুকের মধ্যে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
ঠিক তার পরের দিন থেকেই শুরু হলো অপর্ণার স্বপ্নপূরণের প্রস্তুতিপর্ব।
অপর্ণা দিনের শুরুতেই ডায়েরি খুলে লিখতে বসে- "স্বপ্ন আমার হাতছানি দেয়, সোনার কাঠি স্পর্শ করে;
স্বপ্ন পূরণ করতে চাই, রাখিস আমায় যত্ন করে।"


                                                                                                                 
                                                                  অস্মি সেনগুপ্ত ©


                                                              =>> দ্বিতীয় খন্ড