সোমবার, ৭ মে, ২০১৮

" জগদ্ধাত্রী পূজা ও কৃষ্ণনগর " - গৌরব হালদার


        কৃষ্ণনগরে দূর্গাপূজা কার্যত গ্রুপ লিগ খেলার মত; কালী পূজা সেমিফাইনাল আর জগদ্ধাত্রী পূজা ফাইনাল। কৃষ্ণনগরে জগদ্ধাত্রী পূজা শুরু করেছিলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। আর সেই শুরুর ইতিহাস আজও মানুষের মুখে মুখে পূজার সময় ফিরে আসে।

       বকেয়া রাজস্বের দায়ে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে বন্দী করেন সেই সময়ের নবাব আলিবর্দি খাঁ। এরপর কিছুদিনের মধ্যে নদীয়া থেকে রাজস্ব পাঠিয়ে দিলে আলিবর্দি খাঁ তাঁকে মুক্ত করেন। রাজা নৌকা করে কৃষ্ণনগরে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। নৌকায় ঢাকের আওয়াজ শুনে রাজা বুঝতে পারেন, আজ বিজয়া দশমী। এরপর তিনি দুঃখ ভরা মন নিয়ে বিশ্রাম করছিলেন| হঠাত্ স্বপ্নে তিনি দেখতে পান, এক ঘোড়াদাবা সিংহের উপর একদেবী রয়েছেন। তাঁর হাতে শঙ্খচক্র, তিনি ধনুর্ধারিনী। হঠাৎ একটি ধাতব শব্দে রাজার ঘুম ভেঙ্গে যায়। তিনি পরেরদিন কৃষ্ণনগর পৌছে রাজদরবারে সকলকে জানান তাঁর স্বপ্নের কথা। রাজপন্ডিত সবশুনে তাঁকে বলেন-"উনি দেবী জগদ্ধাত্রী; কার্ত্তিক মাসের তিথিতে পূজিতা হন।" তবে অনেকে আলিবর্দির পরিবর্তে নবাব মীরকাশিম ও নবমী তিথির কথা বলেন|

        অন্য একটি কিংবিদন্তিও জানা যায়--কৃষ্ণনগরে আসার জন্য রাজা আঠারোটি দাঁড়ের পানসি নৌকায় করে রওনা হন| প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তিনি দশমীর রাতেও পৌঁছাতে পারেন নি| দশমীর রাতে তিনি দেখেন রাজ রাজেশ্বরীকে (রাজবাড়ির দূর্গা প্রতিমার নাম)। তিনি রাজাকে স্বপ্নাদেশ দেন বাড়ি গিয়ে তপস্যায় বসতে। দ্বিতীয়দিনে বহু বাধাবিঘ্নের সৃষ্টি হলেও তিনি যেন পিছন ফিরে না তাকান; তবেই তিনি বাক্ সিদ্ধ হবেন এবং সামনে যে দেবীর মুখ দেখবেন তাঁকেই পূজা করবেন | তারপর কৃষ্ণচন্দ্র তপস্যায় বসলেন। প্ৰথমদিন ভালোভাবে কেটে গেল। দ্বিতীয়দিনে তিনি ভূতপ্রেতের বিকট চিৎকারে ভয় পেয়ে পিছনে তাকাতেই দেখলেন জগদ্ধাত্রী| তখন থেকেই পূজা শুরু হয়।

        শুরু থেকেই কৃষ্ণনগরের পূজা ছিল একদিনের; কার্ত্তিক মাসের শুক্লা নবমীর দিন। দশমীতে বিশাল শোভাযাত্রা সহযোগে বিসৰ্জন হত | শোভাযাত্রার শুরুতে থাকত রাজকীয় বেশে একটি হাতী। সঙ্গে থাকতো ঘোড়া, ঢাক, ঢোল, সানাই। কৃষ্ণনগরের রাজপথে সপারিষদ রাজা যেতেন। বর্তমানে রাজ-রাজত্ব নেই, তবুও এখনও কৃষ্ণনগরের মানুষ পূজার সময় একবার রাজবাড়ির পূজা দেখতে যাবেই যাবে। এখন আর রাজপথে রাজবাড়ির প্ৰতিমা আসে না, রাজবাড়ির দিঘিতেই বিসৰ্জন দেওয়া হয়। প্ৰচলিত আছে এটি একটি নদী যার নাম অঞ্জনা। তবে এখন বয়স্ক মানুষরা অঞ্জনা খাল বলেন|

        কৃষ্ণনগরে পূজা শুরুর পর রাজা কৃষ্ণচন্দ্র কৃষ্ণনগরের বিভিন্ন জায়গায় পূজা ছড়িয়ে দেন। মূলত রাজার অনুদানেই পূজা হত। এখন শুধুমাত্র একটি বারোয়ারী পূজার জন্য সাম্মানিক অনুদান পায়। বেশকিছু বারোয়ারী ও ক্লাবে প্ৰতিমার একটি  করে নামও থাকে, যেমন- বড়মা, মেজ মা,ছোট মা, ভালো মা, সোনা মা, মিষ্টিমা, অন্নপূর্না, মণি মা,চারদিনী মা, বুড়িমা, জলেশ্বরী ইত্যাদি।
পূর্বে শুধুই পূজা, প্ৰতিমা ও প্ৰতিমা বিসৰ্জনই আকষর্নের কেন্দ্র ছিল। রাজবাড়ীর প্ৰতিমা নিরঞ্জনের পর এক এক করে সব প্ৰতিমা রাজবাড়িতে নিয়ে যাওয়া হত। রাজবাড়ী থেকে উপহার হিসাবে পিতলের ঘড়া দেওয়া হত। ঘড়াটিকে বাঁশের মাথায় লাগিয়ে প্ৰতিমা আড়ং বা সাং-এর মাধ্যমে কদমতলা ঘাটে বিসৰ্জন দেওয়া হত। রাজবাড়ী থেকে এখন আর কোন উপহার দেওয়া না হলেও, প্ৰতিটি প্ৰতিমাকে এখনো রাজবাড়ী ঘুরিয়ে রাজপথ দিয়ে নিয়ে আসা হয়। রাজপথের কোন এক জায়গায় অপেক্ষা করলে সব প্ৰতিমা দেখা যায়। বর্তমানে দুইদিন ধরে প্ৰতিমা বিসৰ্জন হয়। দশমী, অর্থাৎ বিসৰ্জনের প্ৰথমদিন সকালে ঘট বিসৰ্জন শোভাযাত্রার আয়োজন হয়। কিছু বারোয়ারী এতে অংশ নেয়। বিভিন্ন ট্যাবলো সহযোগে এই শোভাযাত্রা হয়। রবীন্দ্রনাথ, নেতাজী থেকে এ.পি.জে. আব্দুল কালাম, শাহরুখ খান থেকে দেব, বিভিন্ন সরকারী প্ৰকল্প, সচেতনা,পূজার ইতিহাস উঠে আসে ট্যাবলো তে, যা দেখতে রাজপথে রোদ্দুরে অপেক্ষা করে বহু মানুষ ভিড় করেন। সাথে বহুরকমের বাজনা, মুখে "উই উই", "আসছে কারা???"" বলে পাড়ার নাম ধরে সমবেত আওয়াজ, কখনও তাদের প্ৰতিমার নাম করে জয় জয় ধ্বনি, মাঝে মাঝে হাততালির সমবেত আওয়াজ, প্ৰতিমা নিরঞ্জনে সময় আড়ং বা সাঙ মানে কাঁধে করে প্ৰতিমা নিয়ে ঢাকের তালে লাফালাফি করে দৌড়ে আসা-- এটাই আনন্দ। 

কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বারোয়ারী :

চাষাপাড়া-- প্ৰথম বারোয়ারী হিসাবে প্রথম বছর ঘটপূজা শুরু করে। দ্বিতীয় বছর পটচিত্রে এবং তারপরের বছর থেকে প্ৰতিমার মাধ্যমে পূজা হয়, যা সারাদেশে জনপ্ৰিয় "বুড়িমা" নামে। এবছর ২৪৪তম বর্ষ। দেবীকে এখানে স্বর্নালঙ্কারে সাজানো হয়। 

মালোপাড়া-- এখানকার মা 'শ্ৰী শ্ৰী জলেশ্বরী দেবী' নামে বিখ্যাত| ঐতিহ্যকে সঙ্গী করে এই বারোয়ারী রয়েছে। এই বারোয়ারী কৃষ্ণনগরের একমাত্র বারোয়ারী যারা এখনও রাজ পরিবার থেকে অনুদান পায়। পূজার আগেরদিন রাতে ছেলেরা মেয়ে সেজে জল আনতে যায় জলঙ্গী নদীতে। এই প্ৰথার নাম জলসজ্জা। এছাড়া ঐতিহ্যের মধ্যে আছে ধুনো পোড়ানো, বলি প্ৰথা। এখনো এখানে কার্বাইট গ্যাসের আলো বিসৰ্জনের সময় মায়ের মুখ উজ্জ্বল করে, যা দেখতে সবাই একবছর অপেক্ষা করে থাকে।

বাঘাডাঙ্গা-- কৃষ্ণনগরের অন্যতম পুরনো পূজা। নতুন থিম, বাঘ-সিংহের লড়াই-এ দেবীর অবস্থান।

কাঠালপোতা বারোয়ারী-- মূলত প্ৰতিমা নির্ভর পূজা।

রাধানগর অন্নপূর্না সরণী-- থিমের জোয়ার। এবারের আকর্ষণ কর্ণাটকের মাদুরেশ্বর শিব মন্দির।

শক্তিনগর এম.এন.বি-- বড় বাজেটের থিমনির্ভর পূজা।
এছাড়া থিমের কাজ দেখা যায়- ঘূর্ণি ভাই ভাই, ঘূর্ণি শিবতলা, ঘূর্ণি হালদার পাড়া, তাঁতিপাড়া, দর্জিপাড়া, শক্তিনগর পাঁচ মাথা মোড়, আমিন বাজার,  বাগদি পাড়া প্ৰভৃতি স্থানে।

মাদল--কৃষ্ণনগরে "মাদল" জনপ্ৰিয়তা লাভ করেছে। শিল্পী সায়ন তরফদারের হাত ধরে নতুন ভাবনাকে সাথে নিয়ে তারা এবার সাত বছরে। অভিনব প্ৰতিমা ও বিষয়ভাবনাকে নিয়ে শহরে আলদা জায়গা করে নিয়েছে।ষসাধারণত প্ৰতিমা প্ৰতিটা বারোয়ারী একই রাখে, কিন্তু মাদল প্ৰতিবছর নতুন নতুন ভাবনায় তাদের প্ৰতিমা ও মণ্ডপসজ্জা করছে, যা শহর বাসীর কাছে নতুন পাওয়া।

রাজদূতক্লাব, ক্লাব বিশ্বরূপা, চকের পাড়া--সুসজ্জিত প্ৰতিমা 

নুড়িপাড়া বারোয়ারী -- কৃষ্ণনগরের একমাত্র পূজা যা চারদিন ধরে হয়। তাই এখানকার প্ৰতিমা চারদিনী মা নামে খ্যাত।

কালিনগর ক্লাব রেনবো-- নতুন নতুন থিমের ভাবনায় নজরকাড়া, বড় বাজেটের পূজা।

পাত্রবাজার স্বীকৃতি -- থিমেই বাজিমাত করে পাত্রবাজার।

হাতারপাড়া-- ঘট বিসৰ্জন মূল আর্কষণ।

      এছাড়াও কয়েকটি বড়পূজা হল--যুবগোষ্ঠী, গোলাপট্টি, উকিলপাড়া, কাঠুরিয়া পাড়া, ষষ্ঠীতলা, নেদেরপাড়া, বৌবাজার, শক্তি সংঘ, চৌধুরী পাড়া, রায়পাড়া-মালি পাড়া, বালকেশ্বরী, জজকোর্ট পাড়া,কলেজষ্ট্রীট, নাজিরা পাড়া, ক্লাব একতা, সেন্ট্রাল ক্লাব, আমরা কজন, অনন্যা ইত্যাদি | বাড়ি, ক্লাব ও বারোয়ারী মিলিয়ে ছোটবড় প্ৰায় ৪৫০ টি মত পূজা হয়। সর্বশেষে বলতেই হবে কৃষ্ণনগরে পূজা আবেগের, ভালোবাসার ।

©  গৌরব হালদার






" এক শীতের সকাল " - মনোজ রায়


        "কিগো  শুনছো..!! কত বেলা হয়ে গেল  তো। এবার  ওঠো।"

        আমি পাশ ফিরে চাদরটা মুড়ি দিয়ে আবার শুয়ে পড়লাম। হঠাৎ মাথায় এলো আজকে অফিসে বস কে রিপোর্টটা জমা দিতে হবে। কাজটা কালকে বস আমাকে দিয়েছিলো। হুড়মুড় করে বিছানায় উঠে বসলাম। ঘড়িতে  তখন ৮:১৫ বাজে। অর্পিকে ডেকে বললাম, "জলটা গরম করে দাও তো তাড়াতাড়ি"।

        অর্পিতা, আমার বউ। ভালোবেসে অর্পি বলে ডাকি।

        স্নান সেরে এসে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিলাম। ওদিকে অর্পি ব্রেকফাস্ট টেবিল  সাজাচ্ছে। অফিসের কাগজ-পত্রগুলো আমার টেবিলেই রয়ে গেছে। রাতে  কাজ করতে করতে আর গুছিয়ে রাখা হয়নি।

        "উফফফ...!! পেপারগুলো যে আটকাবো, একটা পেপার ক্লিপও পাচ্ছিনা।" টেবিলে, ড্রয়ারে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিলাম। এদিকে ৯টা বেজে গেছে। ৯:২৫ এর বাসটা ধরতেই হবে। শেষমেষ একটা পেপার পিন খুঁজে পেলাম। কাগজগুলোকে আটকে ফাইলে ভরে নিলাম। ড্রয়ারটা বন্ধ করতে গিয়ে হঠাৎ চোখ পড়লো  ড্রয়ারের ভেতরে শেষ  প্রান্তে.. একটি  গোলাপি  রঙের  কাগজ। অনেকদিন পড়ে থেকে কেমন যেন ধূসর হয়ে এসেছে। কাগজটি  হাতে  নিয়ে  খুলতেই ... 
         "তোমাকে পাওয়া আমার ভাগ্যে নেই, 
কিন্তু তুমি আমার হৃদয়ে চিরদিনের মতো বাসা করে নিয়েছো। 
অনেক কিছু না বলা রয়ে গেল। ভালো থেকো  ....সুখে  থেকো ...।

                                          --- তোমার কাছের বন্ধু 
                                                     অনিতা "

        পড়তে পড়তে পৌঁছে গেলাম ৭ বছর আগের কলেজ লাইফে। কলেজের প্রথম দিন ...,অটো থেকে নেমে একটা গভীর শ্বাস নিয়ে কলেজের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম| তারপর গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, "দাদা ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাসটা কোথায় বলতে পারবে?" 
---কোন রুমে বলতে পারছিনা তবে দোতলাতে হয়।"
---আচ্ছা ঠিক আছে, ধন্যবাদ।"

আমি দোতালার দিকে এগোতে লাগলাম। হঠাৎ পেছন থেকে শুনতে পেলাম..
---"এই  যে  কি  হচ্ছে  এসব?" 
ঘুরে দেখি একটি মেয়ে। আমি কিছু বলার আগেই আমার গালে একটা চড় বসিয়ে দিল। সেই মুহূর্তে কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না কি হলো। কিছুক্ষণ পর ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম যখন মেয়েটি বললো,
---"আমি তোমাকে চিনিনা জানিনা; তোমার সাহস কি করে হলো আমাকে চিঠি  দেওয়ার? এরপর যদি এরকম করেছো তো সোজা জেলের হাওয়া খাইয়ে দেব।"
এই বলে সে সেখান থেকে চলে গেলো। আমি কিছু বলার সুযোগ ও পেলাম না।

       যাই হোক, কোনো রকমে ক্লাসরুমটা খুঁজে পেলাম। রুমে ঢুকতেই দেখি সেই মেয়েটি বাঁদিকের দ্বিতীয় বেঞ্চে বসে পাশের বান্ধবীর সাথে কথা বলছে। তখন আমাকে লক্ষ্য করেনি, আমিও আর  কিছু বলতে যাইনি। চুপচাপ ডানদিকের তৃতীয় বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। হঠাৎ করে ওর নজর পড়লো আমার দিকে। ওর চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছিল যেন আবার আমাকে মারতে চাইছে। ক্লাস  শেষে আমি নিজের মত বেরিয়ে গেলাম।

        পরের দিন আমি আবার ডান দিকের তৃতীয় বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। হঠাৎ দেখি মেয়েটি আমার পাশে এসে বসলো।
---"সরি  !!! আসলে আমি অন্য একজনকে ভেবে তোমাকে চড় মেরে ফেলেছি..,I  am  very sorry। কিন্তু তুমি আমাকে কিছু বললে না কেন কালকে?"
---"আমার প্রথম দিন ছিল কালকে। আর যখন চড় মারলে আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ভেবেছিলাম দুটো কথা শোনাবো। তারপর ভাবলাম, প্রথমদিন ঝামেলা করা ঠিক হবেনা। তাই আর  ...."

        এরপর আস্তে আস্তে আমাদের কথা বলা শুরু হয়ে গেলো। আমরা অনেক কাছাকাছি চলে এসেছিলাম। বুঝতেই পারিনি যে কখন ও আমার মনে জায়গা করে নিয়েছে।

        আমরা একটা ফিল্ম দেখার প্ল্যান করেছি। মনে মনে বেশ এক্সাইটেড ছিলামি। রোজকার মতো ডানদিকের তৃতীয় বেঞ্চে বসে ওর অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু সেদিন ও এলো না।ক্লাসে বসে শুধু ওর কথাই ভাবছিলাম। ক্লাস শেষে ওকে অনেকবার কল করার চেষ্টা করলাম কিন্তু কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারলাম না।

        টানা দুদিন ওর কোনো খোঁজ পেলাম না। এরপর একদিন ক্লাসে বসে ওর কথা ভাবতে ভাবতে বুঝতেই পারিনি কখন ক্লাস শেষ হয়ে গেছে। সকলেই চলে গেছে। বুঝতে পারছিলাম না কি হল। হঠাৎ  ওর এক বান্ধবী আমার কাছে এসে বললো.., "এই চিঠিটা তোমার জন্য..  অনিতা দিয়েছে।"
আর কিছু না ভেবেই আমি কাগজটা হাতে নিয়ে পড়তে লাগলাম--

        "তোমাকে পাওয়া আমার ভাগ্যে নেই ..... ... ..।"

        চোখের জল আর আটকে রাখতে পারিনি। হঠাৎ ডাক পড়লো..
---"কি গো, ব্রেকফাস্ট রেডি হয়ে গেছে তো। অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে যে..।" কোনোরকমে চোখের জল মুছে ঘড়ির দিকে তাকালাম....  ৯:১০ বাজে। চিঠিটা আবার ড্রয়ারে রেখে ব্রেকফাস্ট টেবিলে ছুট লাগালাম।

সত্যি .... অনেক কিছু না বলা রয়ে গেল!!

© মনোজ রায়

" ছন্দপতন " - সুফি রায়


নতুন মলজোড়াটা হাতে করে বসে আছে শফরী। গালে নোনা জলের দাগ বসে গেছে। গলা-বুক ভিজে গেছে জলে। কিন্তু চোখের জল যে আজ বাধা মানছে না কিছুতেই। যার কারণ খুঁজতে গিয়ে শফরী তোলপাড় করে ফেলছে তার চার বছর আগেকার জীবন।

    আসলে আজ তার জীবন থেকে চঞ্চল চলে গেল। চঞ্চল তার বন্ধু মাত্র। কিন্তু....। আসলে সেই কলেজের ফার্স্ট ইয়ার থেকেই চঞ্চল ওকে ভালবাসে। শুধু ভালবাসে বললে অনেক কম বলা হয়। শফরীর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সবকিছুই ছিল চঞ্চলের ভালবাসা। কিন্তু শফরীকে সেটা জানিয়েই চরম ভুল করেছিল ও। তারপর থেকে এতগুলো বছর চঞ্চলকে এড়িয়েই চলছিল শফরী। এরমধ্যে সোহম এসেছে তার জীবনে। দুবছরের প্রেম পরিণতি পেতে চলেছে এবার। কিন্তু ঠিক তার আগেই জীবনের ছন্দটা একটু অচেনা সুরে বাজল।

    গতকাল বিকেলে হঠাৎ একটা অজানা নম্বর থেকে ফোন--
   -কি রে.. চিনতে পারছিস?
   -চঞ্চল তুই? কেন চিনব না?
    শফরী সত্যিই চিনেছিল। কেন চিনবে না সে? যতই হোক, খুব ভাল বন্ধু ছিল তারা।
   -বিয়ে করছিস যে জানালি না তো..?
   -আরে সেরকম কিছু নয়। আসলে তোর নম্বর ছিল না তো। তুই কোথায় পেলি আমার নম্বর?
   -মোহনের থেকে। যাই হোক,কাল একবার মিট করতে পারবি? তোর বিয়ের গিফ্টটা নিবি না? আমি তো আর তোর মত কিপটে নই।
    দুজনেই হেসে গড়িয়ে পড়েছিল।
   -এখনো আগের মতই আছিস দেখছি। ওকে.. তবে কাল বিকেলে  কলেজ 

স্ট্রীট মোড়,ওখান থেকে কফি হাউস। আবার আগের মতই।

আজ পৌঁছতে একটু দেরি হয়ে গেল শফরীর। রাস্তার ওপার থেকে তাকে দেখতে পেয়ে সাত দেখিয়ে সেখানেই দাঁড়াতে বলল চঞ্চল। ও আসছে এপাড়ে। আ..আ..! হঠাৎ তীক্ষ্ন হর্ন বাজিয়ে ক্যাঁচ শব্দ করে থেমে গেল গাড়িটা। মুহূর্তে সব অন্ধকার হয়ে গেল শফরীর।

    তারপর থেকে সবকিছু কেমন একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে ঘটে চলল। শফরী স্তব্ধ হয়ে গেছিল চঞ্চলের মৃত্যুর খবরটা শুনে। কানদুটো যেন ঝাঁ ঝাঁ করছে। একটু আগেই তো ছেলেটা দৌড়ে আসছিল তার সঙ্গে দেখা করতে,কথা বলতে। তবে?

   -মিস গাঙ্গুলি..?
    নার্সের ডাকে হুঁশ ফিরল শফরীর।
   -হ্যাঁ বলুন।
   -পেশেন্টের এই জিনিসগুলো..
    মনটা মোচড় দিয়ে উঠল। ওর বিয়ের উপহার নিয়ে এসেছিল ছেলেটা। শফরী ওকে ভালবাসা দিতে পারেনি ঠিকই। কিন্তু এতবছর পরে এক নতুন জীবন শুরু করার আগে সে কোন তিক্ততা রাখতে চায়নি সম্পর্কে। তাই দেখা করতে আপত্তি করেনি। কিন্তু এ কি হল..? কাঁপা হাতে প্যাকেটটা নিল শফরী। তাতে একটা মাঝারি মাপের বাক্স। রঙীন কাগজের মোড়কে তার নাম লেখা। চোখটা একটু ঝাপসা হয়ে আসল তার। বাক্সটা খুলে দেখে তাতে একজোড়া মল। শফরী পায়ে মল পড়তে খুব ভালবাসে। এখনো। সব সময় পড়ে থাকে। মলের সঙ্গে একটা চিরকুট ও রয়েছে। তাতে লেখা- "তোর নতুন জীবনের প্রথম পদক্ষেপ হবে আমার ছন্দে বাঁধা। তোর প্রতিটা শফরী-চঞ্চল পদক্ষেপে বাজবে আমার জীবনের সুর-ছন্দ।"

মুহূর্তে শফরীর বুকটা ভিজে গেল চোখের জলে। শফরীর নতুন জীবন ঠিকই, কিন্তু ও কিছুতেই নিজের মনকে বোঝাতে পারল না কেমন করে ওর এই নতুন জীবনেরই ছন্দপতন ঘটে গেল।

                                                                                                 © সুফি রায়








" আতসবাজি " - সুফি রায়

        "যার বাপের খাওয়ানোর মুরোদ নেই তার বাজি পুড়িয়ে ফুটানি করা চলে না। পিন্ডি জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছি.., আর লাট সাহেবের বেটি বাজি পোড়াবে..। সৎ মায়ের মুখ ঝামটা খেয়েই কেটেছে ঝিলমিলের সারাটা শৈশব। 

        "... .. দিদিইই...,আমার জন্য কী এনেছ??"
—-"আজকে একটা নতুন জিনিস এনেছি। এই বলে ব্যাগ থেকে প্যাকেটগুলো বের করে বোনের হাতে দিল ঝিলমিল।
—-"বাজিইইই..???? আআআ... মজা হবে।"

        রাতে আতসবাজির আলোয় যখন বোনের চোখদুটো চকচক করে ওঠে তখন ঝিলমিলের মধ্যেও জেগে ওঠে এক দ্বাদশী কিশোরী। আসলে মা তাকে সৎমেয়ে মনে করলেও বোনকে সে কখনোই সৎমায়ের মেয়ে ভাবেনি। তাই বোনের খুশিকে আকণ্ঠ পান করেই বাজি পোড়ানোর আশ মেটায় ঝিলমিল।

© সুফি রায়











" ভাইফোঁটা " - সুফি রায়



        নতুন বউ আসার পর থেকেই ভাইটা কেমন বদলে গেছে। ওকে মানুষ করার জন্য যে দিদি অবিবাহিত থেকেছে সেই দিদিকেই এখন ওর বোঝা মনে হয়। তাই বউকে নিয়ে চলে গেল আলাদা সংসারে। কিন্তু তাই বলে আজকের দিনেই চলে যাবে ও?? এভাবে, ভাইফোঁটা না নিয়েই!! দিদির কান্না কি ওর কানে গেলই না??

       ফোনটা বেজে উঠল। ওপাশে নতুন বউ কান্নায় ভেঙে পড়েছে, "তোমার ভাইয়ের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে দিদি।" শুনে হঠাৎ ফ্যাকাশে হয়ে গেল অসীমা। কিনতু পরক্ষণেই তার ফ্যাকাশে মুখে খেলে গেল এক ক্রূর নিষ্ঠুর হাসি... "দেখলি তো ভাই, আমার থেকে ফোঁটা না নিয়ে কি ভুল করেছিস..!!"

                                                                                                        ©  সুফি রায়















"আমি আছি.. আমি নেই" - অনির্বাণ রায়


কলেজ স্ট্রীট থেকে কেনা কবিতার সংকলনে..
বিকেলে শোনা রেডিওর প্রেমের বাংলা গানে
আমায় খুঁজিস না, ওখানে আমি তো নেই।

আমায় খোঁজ করে দেখ কলেজ নোটের পাতায়।
জুলজির কপিতে, B.K.D এর খাতায়
পেন্সিলের আঁচড়ে; আমার অস্তিত্ব থোর খাতাতেই।

ভালোভাবে খুঁজে দেখ—
আমি আছি তোর কলেজ নোটে।
আমি বাঁচি, তোর ভেজা ঠোঁটে।

DVD-র চেনা-অচেনা প্রেমের সিনেমাগুলোতে..,
সন্ধ্যাবেলায় cleansing milk-এর ভেজা তুলোতে
আমি থাকি না; সেখানে তো আমার থাকতে নেই।

অভ্যাসের বাইরে বেরিয়ে আনমনাদের হাত ধরে—
ঘুমের আচ্ছন্নতায় যদি কেউ এসে জড়িয়ে ধরে
তবে তো সে তোকে অবাধ্য হয়ে রূপকথা শোনাবেই।

ভালোভাবে শুনে দেখ,
আমি থাকি তোর রূপকথাতে।
আমি রাখি ভোর তোর ঘুমে ভেজা বালিশের মাথাতে॥


                                      ©  অনির্বাণ রায়













"একলা বসে" - সুফি রায়

যখনই থাকি একলা বসে
       তোমায় নিয়ে ভাবি,
তোমাকে আমার কবিতা করে
       হয়েছি তোমার কবি।

যখনই থাকি একলা বসে
      মনেতে ছবি আঁকি-
জ্যোৎস্না ভরা মুখখানাতে
      কাজল মাখা আঁখি।

মিষ্টি কথার দুষ্টুমিতে
      বাজল মনে বাঁশি,
লাল লাল ঐ ঠোঁটের কোণে
       এক চিলতে হাসি।

যখনই থাকি একলা বসে
       তোমায় খুঁজে বেড়াই..,
তোমার কথা ভেবে ভেবে
        এ মন যে তাই হারাই।

যখনই থাকি একলা বসে
         তোমায় যে মন চায়-
অজান্তিতেই শূন্য দিশায়
        শুধুই দু-হাত বাড়ায়।

যখনই থাকি একলা বসে
     তোমায় মনে পড়ে,
তাই বুঝি দু-নয়ন আমার
       স্বপ্ন - প্রাসাদ গড়ে ।।


               © সুফি রায়












"মৃত্যুমুখী প্রেম" - অনির্বাণ রায়



তুই নেই তাই পুড়ছে সময় দু ঠোঁটের ফাঁকে,
'তুই আসবি' বিশ্বাসের চশমা আটকে রাস্তার বাঁকে।
তুই নেই তাই রক্তেরা শান্ত দীঘির জল
তোর অপেক্ষা আর কত করব বল..।
আমার ঠোঁট মিশেছিল যবে তোর ঠোঁটে...
অনুভূতিরা বন্দী হয়েছিল স্নায়ুদের যানজটে।
যাচ্ছে সময় আর পুড়ছি আমি--
ঠোঁট হচ্ছে ক্ষয়িষ্ণু বাদামি।
মৃত্যুর দিকে ছুটে যায়, সমস্ত প্রেম...
সমস্ত ট্রেন
সমস্ত ড্রেন
সমস্ত প্রেম.. মৃত্যুর দিকে ছুটে যায়।



                               ©  অনির্বাণ রায়

"এমন কেন হয়?" - সুফি রায়



বলতে পারিস, এমন কেন হয়?
এখনো আমার মনটা কেন তোকেই ঘিরে রয়?

যখন তোকে প্রথম দেখি ছাদের চিলেকোঠায়,
বিকেলবেলার রোদ পড়েছে গাছের মাথায় মাথায়।
কীসের টানে হঠাৎ করে
স্বপ্নগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ে,
খুলে দিয়ে মনের আগল, ভাসল উজানে।
বলতে পারিস, কোন তুফানে?
আজও আমার মনটা এমন উতল অকারণে।

সেদিন যখন বাড়ির পথে,তোর হাতটা আমার হাতে,
কেমন যেন এক শিহরণ জাগালো আমার বুকের মাঝে।
আজও খোঁজে আমার দুচোখ,
সেই দুটো হাত, নরম আদর---
সেই প্রথম দিনের আলতো ছোঁয়া
আজ যেন সব কালচে ধোঁয়া।
বলতে পারিস, কী ভুল ছিল?
তোর ঠিকানা বদলে গেল. . .

সেদিন যখন ঘুম ভাঙালি
"পথ আলাদা", বলতে এলি---
ভুলে গেলি সেই চেনা গান,
অনেক কথা, মান-অভিমান,
জানলি না তো কোনখানেতে গোপন ব্যথা বাজল,
কিসের ব্যথায় মনটা এমন মোচড় দিয়ে উঠল..।

বলতে পারিস,স্মৃতিগুলো তাড়িয়ে কেন বেড়ায়?
আজও আমার মনটা কেন শুধুই তোকে চায়?

                         
                                            ©  সুফি রায়