রবিবার, ১৯ মে, ২০১৯

" পুনরাবর্তন " | শিল্পী মণ্ডল


ওই শোনা যায়, ধর্মের  অট্টহাসির শব্দ ...
দুই দলের খেলায় আবার মানুষ হচ্ছে জব্দ।
মানুষে মানুষে হানাহানি, আর সেই চিরস্থায়ী দ্বন্দ্ব।
ধর্ম আজও সেই সাম্প্রদায়িকতার মুখ্য প্রতিবন্ধ॥
ধর্ম আর রাজনীতির সেই পুরাতন ঘৃণ্য সন্ধি, 
মানবিকতা হয় যেখানে নিঃশব্দে বন্দি।
ধর্মের নামে মানুষ খুনের চরম নির্মম সত্য
আজও যেন সেই রক্ত ঝড়ানো ইতিহাস অনবদ্য।
ইতিহাস আজ আবার জেগেছে নৃশংসতার ছোঁয়ায়...... 
মানবিকতা ঢাকছে আবার ধর্মের অন্ধ মায়ায়॥


                                                                                              
                                         শিল্পী মণ্ডল ©

" ইচ্ছে " | অক্ষয় মণ্ডল


মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে, পাখি হয়ে যাই।
পাখিদের কত মজা, জানি আমরা সবাই II
এখন আমি আকাশটাকে, দেখি চেয়ে চেয়ে।
পাখি হলে বলতাম কথা, তার সাথে গিয়ে॥
হতাম আমি বন্য পাখি, ঘুরতাম নানা দেশ।
গাছেদের সাথে আমি বলতাম কথা বেশ॥
পাখি হয়ে আকাশেতে দিতাম আমি পাড়ি।
পাড়ি দিয়ে যেতাম আমি মেঘেদের বাড়ি॥
দেখতাম চেয়ে মেঘগুলো সব ওড়ে কেমন করে।
উড়তাম আমি সারাটা দিন মস্ত আকাশ জুড়ে॥
কিন্তু যদি পড়ি ধরা কোনো শিকারির ফাঁদে।
জীবন আমার হবে বৃথা, মরব কেঁদে কেঁদেII
এই কথা ভাবি যখন, বড়ই কষ্ট হয়।
পাখি হওয়ার ইচ্ছে আমার, ধুলোয় মিশে যায়॥


                                                                                        
                                  অক্ষয় মণ্ডল ©

বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০১৯

" শিক্ষক " | ধ্রুব বিকাশ মাইতি


চলিত এই দিনে
জাগছে মনে প্রাণে...
শিক্ষক মানে সৃষ্টিকর্তা মোদের সবার,
সুন্দর জীবন
সাধ্যের জোরে করেন গঠন,
শিক্ষা সংগ্রামে লড়ছি মোরা হতে তাঁদের মতন।
শিক্ষক মানে বাবার আদর...
দেখান ওনার পরিচালনার কদর,
শিক্ষক মানে শীতের চাদর গরমের জন্য বাতাস;
ওনার সব সাধু আচার 
বাড়ায় মোদের বিশ্বাস।
শিক্ষক মানে সাজানো সমাজ
বন্ধুর মতো সাথি
ওনাদের দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে কত রথী-মহারথী।
শিক্ষক মানে শিক্ষা গুরু, মানুষ তৈরীর কারিগর
উনি ব্রহ্মা উনি বিষ্ণু উনি মহেশ্বর।
শিক্ষক মানে আদর্শ,
সর্ব কর্মনিষ্ঠা, জ্ঞান, মান—
শিক্ষক মানে দায়িত্ব পালনের অনন্য অভিধান।
শিক্ষক মানে সুখের ছায়া—
শিক্ষক মাানে তৃপ্তি,
সমস্যাদের সমাধান আর
পথ চলার গতি।


                                                                                                 
                                           ধ্রুব বিকাশ মাইতি ©

" জীবনপণ " | আবুল হাসেম



ভাবনাশক্তির প্রখরতাই আমি দর্শন পেয়েছি সেই জগৎ,
যা সবার দৃষ্টির অগোচর।
কল্পনাময় জগৎ থেকে তাকে বাস্তবে টেনে আনবোই আপন শক্তিতে।
মানব মনের পশুত্বকে বশ করবো আপন ভাবনা শক্তির তীব্র প্রভাবে।
নবজাতকের অবতারে প্রবেশ করাবো আপন চিন্তন শক্তি।
মানবের অন্তরে লিপিবদ্ধ করবো আপন ভাষা। 
তাদের মুখের ভাষাই আমার প্রাপ্তি
দেবে গতি আপন পথের ধারায়।
সেই ভাবনাতেই জাগ্রত চিত্তে রয়েছি সদা।


                                                                                                   
                                           আবুল  হাসেম ©

নীরব আলো MAY 2019 - PDF ডাউনলোড




নীরব আলো -  মে ২০১৯ " - একটি ছোট্ট এবং সম্পূর্ণ স্বাধীন প্রচেষ্টা আপনাদের মনোভাব সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়ার | আপনাদের মধ্য থেকেই  লিখিত সংগ্রহকে এই পত্রিকার মাধ্যমে প্রকাশিত করা হয় প্রতি মাসে |

পত্রিকাটি কোন রকম ব্যবসায়ীক ক্ষেত্রে ব্যবহিত করার জন্য নয় | এটি একটি সম্পূর্ণ বিনামূল্যের মাসিক ই-পত্রিকা |

" নীরব আলো "মে ২০১৯ সংখ্যা প্রকাশিত হল আপনাদের জন্য  |  ডাউনলোড করুন ,পড়ুন ,আনন্দ উপভোগ করুন এবং এর সাথে নিচে কমেন্ট বাক্স এ আপনাদের মতামত ,অভিযোগ অবসায় জানাবেন  | আপনাদের মতামত নতুন লেখক লেখিকাদের আরো উৎসাহিত করবে  |

আপনারা সকলেই আমাদের মাসিক ই-পত্রিকাটি PDF ফাইল ফরম্যাট এ ডাউনলোড করতে পারবেন নিচের লিঙ্ক টিতে ক্লিক করে  | "ডাউনলোড" বোতামটিতে ক্লিক করলেই ডাউনলোড শুরু হয়ে যাবে | ধন্যবাদ


মঙ্গলবার, ৭ মে, ২০১৯

" স্বপ্নপূরণ " - দ্বিতীয় খন্ড | অস্মি সেনগুপ্ত


               লেখার পরেই অপর্ণার মধ্যে একটা যেন বিদ্যুতের তরঙ্গ বয়ে গেল। কিছুটা অজানাকে জানার কৌতূহল, কিছুটা নতুন কিছুর সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ভয় তার মনকে বার বার নাড়া দিয়ে তুলছিলো।
যথাসময়ে মিঃ বোস বাড়িতে এসে উপস্থিত। আলাপচারিতা শেষে শুরু হলো অপর্ণার ট্রেনিং। প্রথমে শুরু হলো ইংরেজিতে অনর্গল কিভাবে কথা বলতে হয় তার ট্রেনিং। অপর্ণা ইংরেজি ভাষাটা জানলেও ইংরেজিতে কথা বলতে একটু ভয় পায়। আসলে ছোটবেলায় একবার স্কুলে ইংরেজিতে কথা বলার সময় একটু ভুল বলায় তাকে নিয়ে তার বন্ধুরা খুব হাসাহাসি করেছিল। তার পর থেকেই ইংরেজিতে কথা বলার ভয়টা তার মনের মধ্যে বেশ জমিয়ে বাসা বেঁধেছে। এতদিন পর তার মনের মধ্য থেকে সেই ভয়ের বাসা ভেঙে ভয়কে উচ্ছেদ করা যাবে কিনা সেটা নিয়েই হাজার রকম ভাবনা কাজ করেছে অপর্ণার মধ্যে। এতক্ষণ তবু প্রতুল পাশে বসে থাকায় মনে একটু সাহস জুগিয়ে শেখার চেষ্টা করছিল সে। কিন্তু হঠাৎ একটা ফোন আসার পর তাড়াহুড়ো করে প্রতুলের বেড়িয়ে যাওয়ার পর অপর্ণার মনের ভয়টা যেন আরও শক্ত করে নিজের বাসখানা গুছিয়ে নিল। এই মুহূর্তে প্রতুলের তো ওর সাথেই থাকার কথা। কিন্তু এইভাবে ওকে একা ফেলে চলে চাওয়াটা যেন মেনে নিতে পারছেনা অপর্ণা। মোটের ওপর সেদিন সে তেমন কিছুই শিখতে পারলো না। যতটা আশা নিয়ে তার দিনের শুরু হয়েছিলো ততটাই নিরাশার সাথে দিনটা শেষ হলো। তাই ওদিকে ভরে উঠল তার ডায়েরির পাতা-
লেখাতে আজ নেই তো মন,
খাতা কলমও ছিঁড়েছে বাঁধন,
তুই এসে বলবি কখন-
"চিন্তা নেই, আমি আছি তো সারাক্ষণ"।

তার পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে প্রতুল পাশে নেই ,বালিশের ওপর একটা ছোট চিঠিতে লেখা-"অফিসের কাজে একসপ্তাহের জন্য পাটনা যাচ্ছি।নিজের খেয়াল রেখো"। চিঠিটা পড়েই অভিমানের পাহাড় তৈরি হলো অপর্ণার মনে।এইভাবে একটা ছোট চিঠি লিখে চলে গেল, একবার তাকে মুখ ফুটে বলে উচিত ছিল।বিছানা ছেড়ে তৈরি হয়ে নেয় ট্রেনিং এর ক্লাসের জন্য।কিন্তু মনটা সারাক্ষন প্রতুলের দিকেই পরে থাকে আর বার বার ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে প্রতুলের কল বা মেসেজ এলো কিনা।এদিকের বিকালের দিকে হঠাৎ কালো মেঘ জমে  প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়।যেন অপর্ণার কষ্ট প্রকৃতিও বুঝতে পারছে তাই সেও অপর্ণার দুঃখে নিজের চোখের জলকে বৃষ্টি হিসাবে ঝরিয়ে দিচ্ছে।অপর্না তার  নিত্য সঙ্গী ডায়রি খুলে লিখতে শুরু করে-
"বৃষ্টি মাখা সন্ধ্যা জুড়ে মনে পড়ে তোমায় সারাক্ষন,
অপেক্ষায় থাকি,কখন তোমার আসবে টেলিফোন?"

এইভাবেই একটা একটা করে দিন কাটতে থাকে আর অপর্ণার মনের মধ্যে ভয়ের সাথে হতাশা বন্ধুত্ব পাতিয়ে তাদের বাসা শক্ত করে। এখন ইংরেজি শিক্ষার সাথে উচ্চ সমাজে কিভাবে মিশতে হয় তার প্রশিক্ষণও চলছে। ধীরে ধীরে অপর্ণা আর প্রতুলের সম্পর্কের মধ্যে দুরত্ব বেড়েই চলেছে। অপর্ণার প্রতি প্রতুলের কেয়ারিং ভাবটা যে অনেকটাই কমে গেছে সেটা সে ভালোই বুঝতে পারে। এদিকে অপর্ণার খাবারের তালিকায় পরিবর্তন হয়েছে।এখন যা খেতে ইচ্ছা করে কিছুই পায়না তার পরিবর্তে কি সব খেতে দেয় যেগুলো সে আগে কখনো চোখেই দেখেনি,তাতে তার না ভরে পেট আর না ভরে মন। সে ভাবলো তার প্রতি কেয়ারিং ভাবটা হয়তো প্রথম প্রথমই ছিল। কিন্তু মুখ ফুটে সে কিছুই বলতে পারে না।তার মনের কথার একমাত্র সাক্ষী তার ডায়রি।মনের যত মান,অভিমান, কষ্ট ,সুখ দুঃখের গল্প সব ডায়রির পাতা জুড়ে ভর্তি।ডায়রিতে সে প্রায় প্রতিদিন লেখে তার অভিমানের কথা―

"মান অভিমানের চলছে রেশ ,
কোথাও বা সময় শেষ ,
স্বপ্নের বাড়িতে ধূলো জমছে, 
নীরবে মোমবাতি তার প্রহর গুনছে।"

এইভাবেই রেল লাইনের মতো পাশপাশি থেকেও  সামন্তরাল ভাবে চলতে থাকে তাদের বিবাহিত জীবন।ছয় মাস কেটে গেল তবু কোনো কিছুই অপর্ণা শিখে উঠতে পারলো না। কিছু শিখতে না পারার কষ্ট তাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলেছে। শাঁখের করাতের মতো অপর্ণার জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠছে। না পারছে এগিয়ে যেতে আর না পারছে এসব থেকে পিছিয়ে আসতে। যদিও সে একদিন নিজেই চেয়েছিল সমাজে এক বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে। কিন্তু এখন তার জীবন এই ট্রেনিং এর যাঁতাকলে পেষা হয়ে যাচ্ছে।আজ তার মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে।একমাত্র তার মা তার মনের কথা না বললেও ঠিক বুঝে যেত।দু চোখে জল নিয়ে ডায়রির পাতায় লিখতে শুরু করে-
"সম্পর্কের টানাপোড়েনে আমিও অবসন্ন,
সময়ের যাঁতাকলে স্মৃতিরাও আজ বিবর্ণ ।"

একদিন হঠাৎ প্রতুল এসে জানালো যে তাদের কোম্পানীর একটা কনফারেন্সের অনুষ্ঠানে অপর্ণাকে ইংরেজিতে একটি বক্তৃতা দিতে হবে। কথাটা শুনেই আঁতকে উঠল অপর্ণা। সে অনেকবার প্রতুলকে বোঝানোর চেষ্টা করলো যে সে পারবে না কিন্তু প্রতুল তার কথা শোনার পাত্র নয়।
অগত্যা পরের দিন অপর্ণাকে যেতেই হলো অনুষ্ঠানে কারণ তাকে বক্তৃতা দিতে হবে। কিন্তু সে কি বলবে সেটাই তার মাথায় আসছে না।
যথা সময়ে অপর্ণাকে মঞ্চে ডেকে মাইক দেওয়া হলো। একদিকে ইংরেজিতে কথা বলার ভয় আর অন্য দিকে এত মানুষজনকে দেখে সে এতটাই ঘাবড়ে গেল যে মুখ দিয়ে কোনো কথাই বের হয়নি। স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে রইল।
যখন তার হুঁশ ফিরলো মনে মনে খুব দুঃখ পেলো প্রতুলের জন্য। প্রতুল এত আশা নিয়ে ওকে মঞ্চে তুলেছিল, কিন্তু সে নিজের সাথে সাথে প্রতুলেরও মান সম্মান সব ডুবিয়ে দিলো।
বাড়িতে ফিরেই প্রতুল অপর্ণাকে পাশে বসিয়ে রীতিমত জেরা শুরু করলো।
―কি হয়েছে তোমার আজ মঞ্চে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে ছিলে কেনো?
―জানি না কেনো।
―কমপক্ষে দু একটা কথাও তো বলতে পারতে। বলোনি কেনো?
―জানি না।
― তোমার কি শরীর খারাপ?
― না।
এতক্ষণ প্রতুল শান্ত ভাবেই প্রশ্ন গুলো করছিলো। কিন্তু অপর্ণার এরকম উত্তর শুনে মাথায় আগুন যেন আগুন জ্বলছে। মেজাজ হারিয়ে উচ্চস্বরেই অপর্ণাকে কথা শোনাতে লাগলো।
―"জানো তোমার এই জানিনা কারণের জন্য আমার কতটা অসম্মান হলো। সে সম্পর্কে কোনো ধারণা আছে তোমার? গত ছয় মাস ধরে তোমাকে মিঃ বোস ট্রেনিং দিচ্ছেন। তুমি কি এতদিনে আমাদের কোম্পানি সম্পর্কে কিছুই বোঝোনি? তোমাকে উচ্চসামাজে কিভাবে মিশতে হয় সে সম্পর্কেও শেখানো হচ্ছে কিন্তু তুমি এতদিনে কিছুই শিখতে পারোনি। কার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় কিছুই শেখোনি।সেদিন তো খুব বড় মুখ করে বলেছিলে তুমি সব পারবে।কিন্তু এতদিনে এই সামান্য জিনিসটুকু শিখতে পারলে না।"
এতদিনে প্রতুলকে এতটা কোনোদিন রাগতে দেখেনি অপর্ণা। তাই আজ প্রতুলের প্রতিটা কথা যেন তার মনে তীরের মতো বিঁধছিল। তার অজান্তেই চোখের নোনাজল দুগাল বেয়ে বয়ে চলেছে।
"সাহিত্য আমার নেইকো জানা,
বুক জুড়ে শুধু অভিমান মেলে ডানা,
যখন বৃষ্টি হয়ে সে দুচোখ ঝরে-
তখনই মনের কলম মুখ খোলে।"

প্রতুলের মায়ের শরীর অসুস্থ থাকায় তিনি অনুষ্ঠানে যেতে পারেননি। কিন্তু প্রতুলের আওয়াজ শুনে প্রতুলের মা ঘটনার কিছুটা আন্দাজ আগেই পেয়েছেন। তাই কিছু বলবেন বলে দরজার কাছে গিয়ে আবার নিজের ঘরে ফিরে আসেন। কারণ তিনি জানেন তাঁর ছেলে যতটা শান্ত ঠিক ততটাই রাগী।একবার রেগে গেলে তাকে শান্ত করা খুব কঠিন।আবার খুব সহজে নরমও হয়ে যায়।
এদিকে প্রতুল অনর্গল বলেই চলেছে—
― তুমি যেদিন বলেছিলে তুমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাও, কিন্তু একটা সুযোগ চাই, তোমাকে সেই সুযোগটা দেওয়ার জন্যই তোমাকে বিয়েটা করেছিলাম। কারণ আমি আমার কোম্পানিকে বিশ্বের এক নম্বর কোম্পানি হিসাবে দেখতে চাই। আর আমার কোম্পানিকে প্রেজেন্ট করার জন্য চাই তোমার মতো একজনকে। আমার যে বিউটি প্রোডাক্টের কোম্পানি সেটা তো জানোই। আর এই কোম্পানির স্লোগান হলো "বয়স শুধুমাত্র একটা সংখ্যা। সৌন্দর্যতা সর্বদা বজায় রাখুন।" তুমি খুব সুন্দরী নও কিন্তু তোমাকে সুন্দরী করে বিশ্বের সামনে প্রতিস্থাপন করাই ছিল আমার লক্ষ্য। আর সেটা হলেই আমি আমার কাজে সফল হতাম। কিন্তু তুমি শুধু মুখেই বলো নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাও, আসলে তুমি কিছুই পারোনা। শুধু শুধু ছয়টা মাস নষ্ট করলে। জানো এই ছয় মাসে বাকি কোম্পানি কতটা এগিয়ে গেছে? তোমাকে আগেই বলেছিলাম কিছু পেতে গেলে কিছু হারাতে হয়।আর পরিশ্রম ছাড়া কিছু পাওয়া যায় না। সব কি ভুলে গেছো?
এতক্ষণে অপর্ণার চোখ দিয়ে জল পড়া বন্ধ হয়ে গেছে। যেন চোখের জল শেষ হয়ে গেছে। প্রথমে সে প্রতুলের রাগ দেখে কষ্ট পেলেও শেষের কথাগুলো শুনে স্তম্ভিত হয়ে কাঠের মতো নীরব হয়ে গেছে। কিন্তু মনের কোণে থাকা এতদিনের কষ্ট ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে অস্ফুট স্বরে বেড়িয়ে এল—
―"আমি শুধু তোমাকে পাশে চেয়েছিলাম। কিন্তু পাইনি।"
কথাটা শুনে প্রতুলের মন একটু নরম হলো। একটু হেসে বলল,
―এখনো তুমি সেই ছেলেমানুষই রয়ে গেলে। সশরীরে উপস্থিত থাকলেই পাশে থাকা হয় তা নয়, অন্য ভাবেও পাশে থাকা যায়।
―মানে?
―মানে এই যে গত ছয় মাসে তুমি নিজের মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখতে পাওনি?আগে বাড়ি ফিরে দেখতাম তুমি ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তে। বাড়ি ফিরে আমার ইচ্ছা করত তোমার সাথে একটু কথা বলতে। কিন্তু তুমি সশরীরে আমার পাশে থাকলেও তোমাকে আমার পাশে পাইনি। প্রথমে বুঝতাম না এটার কারণ কি। ভাবতাম আমাকে তোমার পছন্দ না তাই আমার সাথে কথা বলতে চাও না, তাই ঘুমিয়ে পড়তে। কিন্তু কিছুদিন পর বুঝলাম সারাদিন ট্রেনিং এর ক্লাস করে তুমি ক্লান্ত থাকো তাই ঘুমিয়ে পর। আর সকালে আমি কাজে বেরোনোর পর তুমি ঘুম থেকে ওঠো। তাই তোমার সাথে আমার সেভাবে কথা বলার সুযোগ হয়নি। নিউট্রিশনিস্টের পরামর্শে তোমার খাবারের তালিকার পরিবর্তন করা হয়েছে। মিঃ বোসকে বলে তোমার ট্রেনিং এর সময় কমিয়েছি। মাকে বারবার ফোন করে তোমার খবর নিয়েছি। অনেকবার ভেবেছি তুমি নিজে থেকে এসে বলবে আমি কেন তোমার খবর তোমার কাছ থেকে নিইনা। কিন্তু তুমি আমাকে কিছুই বলোনি।"

বাচ্চারা প্রথম হাতি দেখলে যেমন অবাক হয় অপর্ণা প্রতুলের কথাগুলো  অবাক হয়ে শুনছিলো।
ওদিকে প্রতুল বলেই চলেছে–
―তোমাকে বিয়ে করেছিলাম হয়তো শুধু নিজের স্বার্থে, কিন্তু ধীরে ধীরে কখন যে তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি নিজেই বুঝতে পারিনি। অন্যদের মতো ফুলের তোড়া নিয়ে হয়তো তোমাকে কোনোদিন মনের কথা বলতে পারিনি। কিনতু তার মানে এটা নয় যে তোমাকে ভালবাসিনা বা তোমার কথা ভাবিনা, তোমার পাশে নেই।শুধু মুখে ভালোবাসি বললেই কি ভালবাসা হয়?ভালোবাসতে গেলে সুন্দর মন লাগে যেটা তোমার আছে।"
―তুমি কি করে জানলে যে আমার সুন্দর মন আছে?
―যে এত সুন্দর লিখতে পারে তার মন সুন্দর না হয়ে পারে?
―মানে তুমি আমার ডায়রি লুকিয়ে পড়েছ?
―লুকিয়ে পড়তে যাবো কেন? সেদিন বাড়ি ফিরে দেখলাম ডায়রিটা পাশে রেখেই ঘুমাচ্ছিলে।হয়তো লিখতে লিখতে ঘুমিয়ে পড়েছিলে তাই ভাবলাম একটু পড়ি।
―তা কি পড়লে?
―আমাকে নিয়ে লেখা তোমার অভিমানের কথা।
তারপর প্রতুল ,অপর্ণার ডায়রির পাতায় লেখাগুলো পর পর বলতে থাকে-
"ভালো লাগে যখন তুমি সব কথাতেই লাগাও মাখন, 
মনের কোণে মেঘ জমেছে, কিছুটা প্রকাশ্য,কিছুটা একান্ত আপন।"

"দেখ তোর জন্য রোদ্দুর নামিয়ে পর্দা টাঙানো,
কোথাও মন নেই, সবচেয়ে দামি এই কথা জানানো।"

"তোমাকে নিয়ে দেখা স্বপ্নগুলো নিয়ে খুব বাঁচতে ইচ্ছা করে,
কিন্তু তুমি তো নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে ব্যস্ত।"

"চারিদিকে এখন প্রেমের মরশুম , 
আর আমি বুনছি বিরহের মাশরুম।"

"রাত্রি হলে নামলে আঁধার,তোমার শহর ব্যস্ত হয় আরো, 
তোমায় নিয়ে এত লিখি,একদিন ও কি পড়ো?"


"প্রেমের কথা  যতই বলি স্বপ্ন এখন অন্য, 
মিলব সেই একই জায়গায় রাস্তা যতই হোক ভিন্ন।"

"অভিমানের অভিযোগ নিয়ে তোমাকে আর দাঁড় করাবো না কাঠগড়ায়, ব্যর্থ আমি ,ভালোবেসে ও আজ আমি অসহায়।"

"খাতা কলম আজ গুনছে প্রহর,
কখন দু কলম লিখবো ভাবে, 
আমিও গড়েছি নিজের শহর ,
যেখানে এসে ভালোবেসে তুমি দুহাত বাড়াবে।"

"ভেবেছিলাম তুমি আর আমি লিখবো দু-এক অক্ষর,
এইভাবেই রেখে যাবো আমাদের প্রেমের স্বাক্ষর।"

প্রতুলের কথাগুলো অপর্না হাঁ করে শুনতে থাকে।মাত্র একবার পরেই প্রতুল তার লেখা গুলো মুখস্থ করে ফেলেছে অথচ সে নিজেই ভুলে গেছে সে তার ডায়রিতে কি লিখেছে।আসলে অপার্নার মনে যা আসে তাই ডায়রিতে লিখে রাখে কিন্তু সব মনে রাখতে পারে না।
প্রতুল বলতে থাকে-"এই যে ম্যাডাম, আপনি তো ভালোই লেখেন।কিন্তু ডায়রির পিছনের পাতা যদি একটু উল্টে দেখতেন তাহলে বুঝতে পারতেন আমার মনের কথা।"
সঙ্গে সঙ্গে অপর্না ডায়রিটা নিয়ে এসে দেখে ডায়রির পিছনের পাতায় লেখা আছে- 
"মন হওয়ায় পেয়েছি তোমার নাম,
জানি না কখন কেনো কিভাবে এতটা ভালবাসলাম।
মনি করে রেখেছি তোমায় চোখের তারায়, 
মনের কথা বুঝবে  কবে হায়!!" 

এখন নিজের ভুল ধারণা ভাঙতেই একটু লজ্জা পেয়ে অপর্ণা মাথাটা নামিয়ে নিলো। এখন নিজের কাছেই খুব ছোট লাগছে নিজেকে। কি যে বলবে কিছু বুঝতে পারছে না। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে আলতো গলায় বলল
―সরি, আমি সত্যি তোমার ভালোবাসা বুঝতে পারিনি। তোমার চাওয়াকে গুরুত্ব দিতে পারিনি। এবার থেকে শুধু আমার বা তোমার স্বপ্ন পূরণের জন্য নয়, আমাদের দুজনের স্বপ্ন পূরণের জন্য নিজেকে তৈরি করব, কথা দিলাম।
প্রতুল অপর্ণার হাত দুটো ধরে বলে উঠল― 
"জোনাকিদের আলো নিয়ে সাজাবো আমাদের ঘর;
অবহেলার ব্যাথা জমছে বুকে, এভাবে করে দিওনা পর।"

অপর্ণা প্রতুলের বুকে মুখ লুকালো।
*         *           *           *           *          *
এক বছর পর――― 
আজ অপর্ণা ইতালির কনফারেন্স হলে বক্তৃতা দেবে। এতদিন দেশেই কয়েকটা জায়গায় বক্তৃতা দিয়েছে এবং যথেষ্ট প্রশংসাও পেয়েছে। কিন্তু আজ বিদেশের মাটিতে প্রথম নিজের বক্তব্য রাখবে, নিজেদের কোম্পানির প্রোডাক্ট নিয়ে। নানা দেশ থেকে আসা গুণী মানুষজন তার কথা শুনবে। প্রথমে একটু ভয় করলেও প্রতুলের হাসি মুখটা দেখে সব ভয় চলে গেল। আসলে মঞ্চে উঠে মানুষজন দেখলেই অপর্ণার মনে যে ভয় ঘুরে বেড়াতো প্রতুলের হাসি সেই ভয়কে তাড়িয়ে দিতে সিদ্ধহস্ত।প্রতুলের হাসি তাকে এতটাই মুগ্ধ করে যে একসময় তার ডায়রিতে লিখেছিল-"ছোট্ট মনের আকাশমণি,ভিন্নতায় ছোঁয়ালো একফালি হাসি,আমি সেই হাসিতেই পোড়াতে চাই আমার সারাটা বেলা....""
বক্তৃতা শেষে পুরো হল হাততালির শব্দে ভরে গেল যেটার স্থায়িত্ব প্রায় পনেরো মিনিট। এটার পরেই অপর্ণার নাম বিশ্বের নানা দেশে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। অপর্ণার নামের মধ্য দিয়েই অপর্ণা আর প্রতুলের স্বপ্নপূরণ হলো।

দিনের শেষে অপর্ণা ফিরে আসে তার সারাজীবনের বন্ধু ডায়েরির কাছে। কলম নিয়ে লিখতে শুরু করে―
"বলেছিলে তোমার ঝাঁ চকচকে শহরে আমি অবাঞ্ছিত আগাছার মতো বেড়ে উঠেছিলাম, তাই তাকে কেটে ফেলা উচিত। ভাগ্গিস সেই ভুল সেদিন করোনি। নইলে আজ যে মানুষগুলো সেই আগাছা থেকে বেড়ে ওঠা মহীরুহের নীচে আশ্রয় খোঁজে তারা আশ্রয়হীন হয়ে যেত।" 



                                                                                                   
                                                   অস্মি সেনগুপ্ত ©
                                                       


                                                     =>> প্রথম খন্ড 

" স্বপ্নপূরণ " - প্রথম খন্ড | অস্মি সেনগুপ্ত



           পরীক্ষার জন্য অনেকদিন ডায়েরীতে কিছু লেখা হয়নি। আজ লিখতেই হবে, না হলে কোনো কাজে মন বসবে না...... এসব ভাবতে ভাবতে ডায়েরি আর পেনটা নিয়ে বসলো অপর্ণা। বসে কিছু না ভেবেই লিখতে শুরু করলো―
"রূপবতী নই তো আমি, নই তোমার স্বপ্নকুমারি, আমি তো এক কল্পবালা, নতুন পরিচয়েই তাই শুরু করলাম তোমার-আমার গল্পমালা।"
লেখা শেষ করে একবার লেখাটা পড়ে নিয়ে নিজের মনেই হাসলো আর ভাবলো, কিসের গল্প আর কার সাথেই বা গল্প— কি যে লেখে মাঝে মাঝে সে নিজেও জানে না।
অপর্ণার শখ, ইচ্ছা বলতে ওই ডায়েরি লেখা। যখন মনে যা আসে বা নতুন কিছু শিখলেও, সেটা রান্নার রেসিপি হোক বা মেকআপ এর কোনো টিপ্স(যদিও তার রান্না বা মেকআপ করতে অত কৌতূহল নেই), অথবা কোন বিশেষ কোনো ব্যক্তির উক্তি— সব সে তার ডায়েরিতে লিখে রাখে। তার বেস্ট ফ্রেন্ড বলতে তার ডায়রি। সে তার বেস্টফ্রেন্ডের নামও রেখেছে "স্বপ্নপরি"।
ডায়রি লেখা শেষ করেই মাকে খাবার দিতে বলে। যথারীতি তার কথা শেষ হতে না হতেই মা তার পছন্দের লুচি আর আলুর দম নিয়ে এসে হাজির।
― তুমি কী করে জানলে মা যে আজ আমার লুচি খেতে ইচ্ছা করছে?
― মেয়ের মনের কথা মা জানবে না তো কী পাড়াপড়শি জানতে আসবে?
― তুমি সত্যি খুব ভালো মা।
― হয়েছে হয়েছে। খাবার সময় অত কথা বলিস না। আগে খেয়ে নে।
― (খাওয়া শেষ করে) কী হলো মা, কিছু বলবে?
― হ্যাঁ, আসলে ঘটকমশায় এসেছিলেন। একটা খুব ভালো সম্বন্ধ এসেছে।
― মা আমি এখন বিয়ে করবো না।
― কেন? বয়স তো হলো তেইশ। আমাদেরও তো দায়িত্ব আছে।
― তাই বলে বিয়ে দিয়ে দেবে? আমি তো আগে একটা চাকরি করতে চাই।
― সে না হয় করবি। ওনারা আসতে চাইছেন, না করব কী করে? আর দেখতে এলেই তো বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না। লাখ কথায় বিয়ে হয়। আর তোর ইচ্ছার কথাটাও ওনাদের জানাস। যদি ওনারা আপত্তি না করে তাহলে ভালো আর আপত্তি করলে আমি ওরকম বাড়িতে আমার মেয়েকে পাঠাবো না।
― কিন্তু মা আমি তো ভালো রান্না করতে পারি না। যদি জিজ্ঞাসা করে কোন রান্নায় কী মশলা দিতে হয় আমি তো কিছুই বলতে পারবো না। ওনারা তখন তো আমার সাথে তোমাদেরকেও অপমান করবে যে মেয়েকে কিছুই শেখায়নি।
― দূর পাগলী মেয়ে সেই ভয়ে কি পাত্রপক্ষের কাছে বসবি না? আর ওনারা এক সপ্তাহ পর আসবেন। ততদিনে তোকে টুকিটাকি সব শিখিয়ে দেব। আর আমার মেয়ে রান্না না জানলেও বাকি যা গুণ আছে তাতে ঠিক পছন্দ করবে।
মা চলে যাওয়ার পর অপর্ণার হঠাৎ করে আজ ডায়রিতে লেখা কথাগুলো মনে পড়লো। তাহলে কি সত্যি ওর জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হলো নতুন গল্পের সাথে?

নির্ধারিত দিনেই পাত্রপক্ষ  অপর্ণাদের বাড়িতে উপস্থিত। পাত্রপক্ষ বলতে পাত্র নিজে, তার মা আর বাবা। আর কেউ আসেনি। পাত্রপক্ষ আসার আগেই অপর্ণা শাড়ি পরে সেজে রেডি। যদিও সে এই ক'দিনে রান্নার টুকিটাকি জিনিসগুলো মায়ের কাছ থেকে রপ্ত করে নিয়েছে। তাও তার মনের মধ্যে ভয়টা কিছুতেই যাচ্ছে না। যদি তারা এমন কিছু প্রশ্ন করেন যেটার উত্তর সে দিতে না পারে। আবার কিছুক্ষণ পরেই তার মনে হয় যে যদি উত্তর দিতে না পারে তো কি হবে? এটা কি কোনো বোর্ড এক্সাম যে সব প্রশ্নের উত্তর জানা বাধ্যতামূলক। কিন্তু উত্তর জানা না থাকলেও পাত্রপক্ষের  কাছে নিজের মূল্য কমাতে নারাজ সে। মনের মধ্যে এরকম নানা প্রশ্নোত্তরের টানাপোড়েনে সে নিজেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলো। সেই সময়েই পাশের ঘর থেকে শুনতে পেল পাত্রের মাকে বলতে-"কই এবার মেয়েকে নিয়ে আসুন।"
অপর্ণা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চায়ের ট্রেটা হাতে নিয়ে মায়ের সাথে বসার ঘরে গিয়ে উপস্থিত হলো। বড়দের প্রণাম সেরে পাত্রকে নমস্কার করে সবাইকে এক ঝলক দেখে নিয়ে বসলো। বসার পরেই তার নাম, কতদূর পড়াশোনা করেছে, কোথায় পড়াশোনা করেছে এসব টুকটাক প্রশ্নগুলো পাত্রের মা সেরে তার ছেলেকে ইঙ্গিত করে বললো ''এবার তোর কী জানার আছে জিজ্ঞাসা কর।"
এতক্ষণ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে অপর্ণার মনে একটু সাহস জন্মেছে। কিন্তু পাত্র আলাদা ভাবে কিছু জিজ্ঞাসা করবে শুনেই আবার তার ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। এত কিছুর মাঝে তো সে ভুলেই গেছে যে সে চাকরি করতে চায় সেটা পাত্রপক্ষকে জানাতে হবে।
― আমার নাম জানেন কিনা জানি না, তাও আর একবার বলছি। আমার নাম প্রতুল ঘোষাল। আমি বিজনেসম্যান। আমার নিজস্ব একটা কোম্পানি আছে। আমার একটাই প্রশ্ন তোমার জীবনের লক্ষ্য কী?

যে প্রশ্নটা স্বপ্নেও কল্পনা করেনি অপর্ণা, পাত্রপক্ষের কাছ থেকে সেটাই তাকে করা হচ্ছে। এটা স্বপ্ন না বাস্তব? আর এটার উত্তরটাই বা কী দেবে ভেবে উঠতে পারছে না। মা পাশ থেকে একটু কনুই দিয়ে ধাক্কা দিতেই মনে হলো এটা বাস্তব, স্বপ্ন নয়।
 কিছুটা আমতা আমতা করে বলতে শুরু করলো, "আসলে আমি চাকরি করতে চাই। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। এমন একটা জায়গায় যেতে চাই যেখানে সবাই যেন আমাকে এক নামে চিনতে পারে। পুরো পৃথিবী ঘুরে দেখতে চাই। মানুষের সাথে মিশতে চাই, তাদের নানান রকম মানসিক দিক বুঝতে চাই।
কথাগুলো বলে একটু দম নিলো অপর্ণা।
― কী চাকরি করতে চাও?
― সেটা এখনো ঠিক করিনি। সবে মাত্র পড়াশোনা শেষ করলাম।
― তোমার স্বপ্ন যদি আমি পূরণ করতে সাহায্য করি তাহলে তুমি কি আমার সঙ্গ দেবে?
কথাটা শুনতেই অপর্ণার চোখে মুখে আনন্দের ঝিলিক খেলে গেল। পরমুহূর্তেই কোথা থেকে একরাশ লজ্জা এসে ওকে রাঙিয়ে দিল। মাথা নিচু করে নিল অপর্ণা। ওর এই মৌনতাকেই সম্মতি ধরে নিয়ে দুই বাড়ি থেকে অপর্ণা আর প্রতুলের বিয়ে ঠিক হয়ে গেল পরের মাসেই।

একদিন বিকালে অপর্ণা আবার ডায়েরি খুলে পেনটা দাঁতের মাঝে নিয়ে ভাবতে থাকে, এইভাবে তাড়াহুড়ো করে বিয়েতে রাজি হয়ে যাওয়াটা কি ঠিক হলো?ছেলেটার সম্পর্কে আরো কিছু খোঁজ খবর নিলে হয়তো ভালো হতো। ছেলেটা কেমন বা তাকে হঠাৎ কেন এক দেখাতেই পছন্দ হয়ে গেল? সে তো অত সুন্দরী নয় যে তাকে এক দেখাতেই সবাই ওর প্রেমে পড়ে যাবে। তাহলে কি ওর চাকরি করতে চাওয়ার ইচ্ছার জন্য ওকে ভালো লেগেছে? ওর আর কী কী পছন্দ অপছন্দ কিছুই তো জিজ্ঞাসা করলো না। হাজারটা প্রশ্ন মনের মাঝে একসাথে ভিড় করে আসছে। শুধু উত্তরগুলো যেন কোথায় অদৃশ্য হয়ে আছে। এসব ভাবতে ভাবতেই অপর্ণা লিখতে শুরু করলো―
"মনের কথা জানলি বল তুই কেমনে,
খোঁজ কি নিস দুইবেলা আমার স্বপনে?
রাখিস যদি তারা করে তোর নয়নে
আঁকবো তোকে কাজল দিয়ে খুব যতনে।"

অপর্ণার যদিও ইচ্ছা একটা চাকরি করবে ,নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে কিন্তু আর পাঁচটা মেয়ের মতো ওর স্বপ্ন একটা ছোট সুখী সংসার হবে। অপর্ণার বাবা গ্রামের একটা প্রাইমারী স্কুলে চাকরি করতেন। তাই অল্প কিছু জমানো টাকা দিয়েই যতটা সম্ভব বিয়ের ব্যবস্থা করলেন। যদিও প্রতুলদের বাড়ির স্টেটাসের সাথে তাদের কোনো তুলনাই হয় না।

বিয়ের দিন যথারীতি সকাল থেকে বাড়িতে আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব সবাই এসে হাজির। বিয়ে উপলক্ষ্যে বাড়ির পরিবেশ একটু অন্য রকম হয়েছে। চারিদিকে ফুল দিয়ে সাজানো। সানাইয়ের সুরের সাথে আনন্দের বন্যা বইছে শুধু। অপর্ণা মনে মনে ঠিক যেমন ভেবেছিল সব সেরকমই চলছে।
যথাসময়ে অপর্ণাদের বাড়ির সামনে বিশাল একটা গাড়িতে করে বর এসে উপস্থিত। বর দেখে আসার পর কিছু আত্মীয় স্বজন নিজেদের মধ্যেই বলাবলি শুরু করলো, "বর যেমন দেখতে তেমনি বড়লোক। অপর্ণার কপাল আছে বলতে হবে।"
অপর্ণার বাবার সারাক্ষণ এই চিন্তাতেই কাটলো যে, অত বড়লোক বাড়ির লোকজন সব, তার এই যৎসামান্য আয়োজনে কি তারা খুশি হবে? তবে  শেষপর্যন্ত সব নিয়ম কানুন মেনেই সুষ্ঠ ভাবে বিয়েটা সম্পন্ন হলো। কনকাঞ্জলি দিয়ে বাবা-মাকে বিদায় জানিয়ে নতুন জীবনে শ্বশুরবাড়ির দিকে গমন করলো অপর্ণা। চোখে সব কিছু ছেড়ে আসার জলের সাথে হাজার স্বপ্ন নিয়ে হাজির হলো শ্বশুরবাড়িতে। তাদেরকে অভ্যর্থনার আয়োজন দেখে তো তার চক্ষু চড়কগাছ। সব কিছু তার কাছে স্বপ্নের মতো লাগছিলো যদিও এই স্বপ্নটা সে আগে কখনো দেখেনি। আচার অনুষ্ঠানের পর্ব সেরে নিজের ঘরে এসে তো আরো চমকে যায়। ঘরটার চারটি দেয়াল চার রকম। চারিদিকে রঙের খেলা। প্রয়োজনীয় প্রতিটা জিনিস খুব সুন্দর ভাবে সাজানো। অপর্ণা ভেবেছিল সে তার নতুন সংসার নিজের হাতে সাজাবে কিন্তু এখানে তো আগে থেকেই সব পরিপাটি করে সাজানো। এসব দেখতে দেখতে সে এতটাই মোহিত হয়ে গেছে যে প্রতুল কখন ঘরে এসেছে সে খেয়ালই করেনি।
― তোমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?
― না না।
― তোমার কিছু দরকার হলে শুধু একবার বলবে সব হাজির হয়ে যাবে।
― আচ্ছা বলবো।
― ঠিক আছে। কাল থেকে অনেক আচার অনুষ্ঠান পূরণ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছো নিশ্চয়ই। একটু বিশ্রাম করে নাও। কাল রাতে আবার বৌভাতের অনুষ্ঠান আছে।
― ঠিক আছে।
প্রতুল চলে যেতে একটু আরাম করে বিছানায় নিজের ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিতে দিতে ভাবলো, প্রতুলকে বাইরে থেকে বোঝাই যায়না যে মানুষটা এতটা  কেয়ারিং।
স্বপ্নের মতো কিভাবে যে একমাস কেটে গেল অপর্ণা বুঝতেই পারলোনা। ইতিমধ্যে তাদের সুইজারল্যান্ডে মধুচন্দ্রিমা সম্পন্ন হয়ে গেছে। তার জীবনে যেন এক নতুন ছন্দ সৃষ্টি হয়েছে। তবে তার সব থেকে যে কাজে ভয় ছিল সেটা তাকে করতেই হয়নি, সেটা হলো রান্না। বাড়িতে তো প্রতিটা কাজের জন্য আলাদা আলাদা কাজের লোক রয়েছে। তার যখন যেটা খেতে ইচ্ছা করতো শুধু মুখ ফুটে বললেই হাজির হয়ে যেত। এত ভালো একটা শ্বশুরবাড়ি এবং এত ভালো মানুষজন তার ভাগ্যে ছিল সেটা তার স্বপ্নেরও বাইরে। শ্বশুর, শ্বাশুড়ি, প্রতুল সবাই তাকে খুব ভালোবাসে, খুব যত্ন করে।

একদিন রাতে খাবার পর প্রতুল অপর্ণার হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে বলল
― তোমার এখানে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?
― অসুবিধা কিসের?আমার তো খুব ভালো লাগছে।
― ভালো তবে। তো তোমাকে যেদিন দেখতে গিয়েছিলাম তুমি তোমার স্বপ্নের কথা আমাকে জানিয়েছিলে মনে আছে?
― হ্যাঁ মনে আছে।
― তুমি কি এখনো সেই স্বপ্ন টা পূরণ করতে চাও?
― হ্যাঁ চাই। এমনিতে বাড়িতে তো সারাদিন বসে থাকি। কোনো কাজ করতেই হয় না। তুমিও বাড়িতে বেশি থাকোনা। যদি একটা চাকরি করতাম সময়টা কেটে যেত।
― ঠিক আছে। তার আগে তোমাকে অনেক কিছু শিখতে হবে। তারপর বলবো তোমার চাকরিটা কী।
― আচ্ছা কী শিখতে হবে?
― সব জানতে পারবে আস্তে আস্তে। কাল থেকে মিঃ বোস আসবেন, তিনি তোমাকে ট্রেনিং দেবেন। তুমি শুধু তার সাথে একটু সহযোগিতা করবে।
― অবশ্যই করবো।
― সব কিছুর আগে একটাই কথা বলে রাখি। সাফল্য কিন্তু এমনি এমনি আসেনা, অনেক পরিশ্রম করতে হবে। অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। মনে রেখো।
কথাগুলো অত না বুঝেই অপর্ণা বলল, "আমি পারবো। তুমি শুধু আমার পাশে থেকো।"
কথাটা বলেই অপর্না প্রতুল এর কাঁধে মাথাটা রাখলো। প্রতুলও অপর্ণাকে নিজের বুকের মধ্যে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
ঠিক তার পরের দিন থেকেই শুরু হলো অপর্ণার স্বপ্নপূরণের প্রস্তুতিপর্ব।
অপর্ণা দিনের শুরুতেই ডায়েরি খুলে লিখতে বসে- "স্বপ্ন আমার হাতছানি দেয়, সোনার কাঠি স্পর্শ করে;
স্বপ্ন পূরণ করতে চাই, রাখিস আমায় যত্ন করে।"


                                                                                                                 
                                                                  অস্মি সেনগুপ্ত ©


                                                              =>> দ্বিতীয় খন্ড

" সমীরণ " - দ্বিতীয় খন্ড | তিতির দত্তগুপ্ত


               "হ্যালো নবমী!!" এই কণ্ঠস্বর শুনে আনন্দে উত্তেজিত হয়ে নবমী বলল, "বাবুই তুই কেমন আছিস? কোথায় আছিস? ঠিক আছিস তো? ভয় পাস না, মনে জোর রাখ..." নবমীকে কথা শেষ করতে না দিয়ে মিশমী ফিসফিস করে শুধু বলল "পুরনো শিব মন্দির", বলেই ফোনটা কেটে দিল।
তখনই তিন বন্ধু মিলে কাবুল দার কাছে গিয়ে সবটা বলে। খোঁজ শুরু হয় পুরনো শিবমন্দিরের। গ্রীন গার্ডেন পার্ক থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে জঙ্গলে একটা ভাঙাচোরা মন্দিরের সন্ধান পাওয়া যায়। মন্দিরের চারপাশে কালো মুখোশধারীদের অতন্দ্র প্রহরা। সেই ঘেরাটোপ সামলে ঢুকতে গেলে একটু সাবধানতার প্রয়োজন, আর প্রয়োজন একটা পরিকল্পনার।

ঠিক হয় কীর্তনীয়ার ছদ্মবেশে মিশমীকে উদ্ধার করতে যাবে পুলিশ ফোর্সের সঙ্গে এবং পুরনো শিব মন্দির সন্ধান করতে করতে হঠাৎ একদিন তারা কাবুলদার কথামত সমস্ত পুলিশ দিয়ে পুরো মন্দির ঘিরে ফেলা হল। তারা জয় রাধেশ্যাম,  জয় রাধেশ্যাম বলতে বলতে ভিতরে প্রবেশ করে দেখে একটি চেয়ারের সাথে মিশমীকে বেঁধে রাখা হয়েছেl প্রিপারেশন অনুযায়ী ওরা ক্রমাগত নামগান করতে থাকবে, আর সেই সুযোগে নবমী মীশমিকে উদ্ধার করবে। কিন্তু বিধি বাম, হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মিশমীকে দেখে নবমী নিজের আবেগকে আর সংযত করতে পারল নাl সে ছুটে গিয়ে বাঁচাতে গেল কিন্তু সহজ ও রনিত নবমীকে বাধা দিল। এতে  অপহরণকারীরা বুঝে গিয়ে গুলিবর্ষণ শুরু করল। নবমী নিজের জীবনকে বিপন্ন করে মিশমীর হাতে পায়ের বাঁধন খুলে মিশমীকে জড়িয়ে ধরলো আর কাঁদতে কাঁদতে বলল, "আই এম সরি, আই এম রেস্পন্সিবল ফর দ্যাট।" ভেতর থেকে অনবরত গোলাগুলির আওয়াজ শুনে পুলিশ ততক্ষণে  মন্দিরে ঢুকে পড়েছে। অন্যদিকে অপহরণকারীদের একজন নবমীকে গুলি করতে গেলে তা সহজের চোখে পড়ে যায়। সহজ নবমীকে ঠেলে সরাতে গেলে,গুলিটা সহজের হাত ছুঁয়ে বেরিয়ে যায়। অপহরণকারীদের সকলকে পুলিশ গ্রেফতার করে ও মীশমীকে উদ্ধার করা হয়। এই কদিনে মিশমী যে মানসিক শক পেয়েছে সেটা দূর করার জন্য তাকে কাবুলদার বাড়িতে রাখা হয়। সহজের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে গেলে প্রাথমিক চিকিৎসা করে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
সংবাদপত্র টিভি চ্যানেলের দৌলতে কোনো কিছুই আর অপ্রকাশিত রইল না। ওদের জীবনে এতবড় একটা ঘটনা, তাও আবার পুলিশী হস্তক্ষেপ— মীশমীর পরিবারে নবমী আর ওর সম্পর্ক ঘিরে একটা সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে। এটা আরো স্পষ্ট হয়ে যায় নবমীর মীশমিকে দেওয়া কিছু চিঠি, আর কিছু কার্ড দেখে। যাতে এই সম্পর্কের পরিধির আর ব্যাপ্তি না হয়, মীশমীকে ভয় দেখিয়ে নবমীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য মীশমীকে কড়া  পাহারায় বাড়িতে আটকে রাখে এবং সব যোগাযোগের মাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া হয়। কলেজ যাওয়ার সুযোগ পেলেও তাও কড়া পাহারার মধ্যে। শুধুমাত্র সহজের ফোনে ভিডিও কলিং ছাড়া মীশমি নবমীর সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না। দুজনেই খুব কষ্টে আছে। মনের মাঝে ওদের একসাথে কাটানো স্মৃতিগুলো শরতের মেঘের মতো ভেসে বেড়াচ্ছে— কোনোটাতে বৃষ্টি তো কোনটাতে মিষ্টি রোদ্দুর। একদিন নবমী বুদ্ধি করে একটা চিরকুট লিখে সহজকে দিল মীশমির কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। চিরকুটে লেখা ছিল "কাল ৩.১৫ এর  Digital Electronics এর লেকচার অফ থাকবে, ওই সময় কলেজের পিছনের গার্ডেনে দেখা করব। তুই পিছনের দরজা দিয়ে চুপিচুপি বেরিয়ে আসবি আমি ওখানেই তোর জন্য অপেক্ষা করবো, সহজ, রণিত তোর বর্ডিগার্ড গুলোকে দেখে নেবে।" মিশমী যথা সময়ে কলেজ গার্ডেনে পৌঁছলো। কলেজের গার্ডেনের চারিদিকে ফুলের বাগান, আর লাল গোলাপ বাগিচা। গার্ডেনে গিয়ে নবমীকে দেখতে না পেয়ে মীশমি নাম ধরে ডাকলো, তৃষ্ণার্ত চাতকের মতো এদিক ওদিক খুঁজতে লাগল। হঠাৎ পিছন থেকে মিশমীর চোখ দুটো কেউ হাত দিয়ে চেপে ধরল। নবমীর স্পর্শ  মিশমীর কাছে অজানা নয়। তখনই মিশমী ঘুরে নবমীকে জড়িয়ে ধরল। "অনেকদিন পর আজ একটু শান্তি পেলাম। এতদিন শুধু শরীরটাই ছিল কিন্তু প্রাণটা তোর কাছে ছিল। সেটা আজ ফিরে এসেছে। বেশ কিছুক্ষণ নিজেদের জমানো অনুভূতি গুলো আদরের চাদরে ঢেকে নিল। কিনতু এইভাবে তো বেশি দিন তো চলতে পারে না। সামনেই ক্যাম্পাসিং, ফাইনাল প্রজেক্ট। তারপরই তো সব শেষ। এদিকে সহজ, রণিত সময় শেষের সিগন্যাল দিচ্ছে। মীশমী নবমীকে আশ্বাস দিল, "সব হবে। তবে আমাদের এখন একটাই কাজ,  ক্যাম্পাসিংয়ে যেকোনো প্রকারে একটা চাকরি পাওয়া ।

——————————

মীশমি আর নবমী দুজনেই এখন হায়দ্রাবাদের এক নামকরা মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানিতে সফটওয়্যার ডেভেলপার হিসেবে কর্মরতা। যদিও অনেক কসরতের পর কাবুলদার এক বন্ধুর সহযোগিতায় হায়দ্রাবাদে পোস্টিং নিয়েছে নবমী। সহজ এবং রণিত দুজনেই হায়ার   স্টাডিজের জন্য হায়দ্রাবাদে, সাথে একটা কোম্পানির হয়ে প্রজেক্টের কাজও করছে। মীশমি কোম্পানি থেকে সুসজ্জিত ফ্ল্যাট পেয়েছে, ওখানেই ওরা তৈরী করে নিয়েছে নিজেদের ভালোবাসার সুখী গৃহকোণ। নবমীর ফ্যামিলি থেকে কোন প্রবলেম নেই, ওনারা সম্পর্কটা বেশ মেনেই নিয়েছেন। কিন্তু মীশমির ফ্যামিলি এখনও মেনে নিতে পারেনি। শতসহস্র বাধা দেওয়া সত্বেও মেয়ের জেদের কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছেন তারা। দৈনিক রোজনামচা, অফিস থেকে ফিরে গৃহস্থালীর টুকটাক কাজ, অফিসের অ্যাসাইনমেন্ট, সপ্তাহান্তে কাছে পিঠে ঘুরতে যাওয়া, শপিং, মুভি বেশ ভালোই চলছে। 

এইরকমই একদিন ওরা নিজেদের গাড়ি নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছে। বেশ ফুরফুরে মেজাজে গল্প করতে করতে যাচ্ছে। গাড়ির স্টিয়ারিং নবমীর হাতে। হঠাৎই চোখে একটা তীব্র আলো আর সঙ্গে প্রচণ্ড ঝাকুনি। হতচকিত হয়ে শেষ মুহূর্তে কন্ট্রোল করতে গিয়েও শেষ রক্ষা করতে পারেনি নবমী। গাড়িটা গিয়ে ধাক্কা মারল একটা ল্যাম্পপোষ্টে। তারপরই সব অন্ধকার। মীশমীর আর কিছু মনে নেই।

অ্যাক্সিডেন্টের খবর পেয়ে সহজ, রণিত তড়িঘড়ি হসপিটালে পৌঁছোয়। দুজনেরই  সিরিয়াস অবস্থা, তবে নবমীর অবস্থা আরো বেশী ক্রিটিকাল। নবমীকে ICU তে রাখা হয়েছে। 
দুজন গেল ডাক্তারের সাথে কথা বলতে। মীশমীকে মেডিসিন, ব্লাড দেওয়া হচ্ছে। মেডিক্যাল বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই সব চলছে। তবে এখনও জ্ঞান ফেরেনি। দুটো ছোট অপারেশন করতে হতে পারে। সেগুলো সময় মত জানাবো। যেহেতু জ্ঞান ফেরেনি এখনো তাই ৪৮ ঘন্টা না কাটলে কিছু বলা যাচ্ছেনা। 
"আর নবমী?" জিজ্ঞাসা করল রণিত।
— আমাদের হাতে আর কিছু নেই, আপনারা ওর সাথে দেখা করে নিন।
কিছুটা উত্তেজিত হয়েই বলল রণিত, "আপনাদের হাতে কিছু নেই মানে কী? কি করতে হবে বলুন, সমস্ত ব্যবস্থা করে দেবো। কিন্তু নবমীকে যেভাবে হোক বাঁচিয়ে তুলুন।"
— Clam down my child... নবমীর ব্রেন হেমারেজ হয়ে এত ব্লিডিং হয়েছে যে সেটা আর পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। হার্ট পুরো শরীরে ব্লাড সারকুলেট করতে পারছে না।  যা ব্লাড দেওয়া হচ্ছে, সেটাও আর শরীর নিতে পারছে না, বডি সাপোর্ট করছে না। রক্তে লিপিডের পরিমান খুব বেড়ে গেছে। চিকিৎসাশাস্ত্রে একে বলে Coronary Thrombosis। আর তাছাড়া, যে বাঁচতে চায় তাকে বাঁচানো যায়। কিনতু উনি তো কোনো ট্রিটমেন্টই নিতে চান না। যাই হোক, উনি সহজ নামে কারোর সাথে দেখা করতে চান।
ওরা দৌড়ে গেল। সহজ নবমীকে ঐ অবস্থায় দেখে আর নিজেকে সামলাতে না পেরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। নবমী সসজকে দুখেই ওর হাতদুটো জড়িয়ে ধরল, "আমাকে ছুঁয়ে কথা দে, তুই মীশমিকে  আগলে রাখবি। ওকে কখনো জানতে দিবি না আমি আর তোদের মধ্যে নেই, আমাকে প্রমিস কর সহজ। না হলে, আমি মরেও শান্তি পাব না।"
— তোর ভালোবাসাকে আমি কি তোর মত করে আগলে রাখতে পারব? না  তোর মতো নিঃস্বার্থ ভালবাসতে পারব?
নবমী উত্তেজিত হয়ে বলে, "তুই পারবি, পারতে তোকে হবেই..." কথাটা বলেই নবমী চুপ করে যায়। তার মাথাটা কেমন নেতিয়ে পড়ে। রণিত দেখে Cardiac Monitoring  System এ হার্ট বিট ফলাকচুয়েট করছে। ওর শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা ক্রমশ কমছে, নবমী প্রাণপণ চাইছে জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে আরো একটু বেঁচে থাকতে, আরো কিছু বলতে। কিনতু শেষ কথাটা বলতে চেয়েও আর বলা হল না। সহজ দুবার নবমী, নবমী করে ডাকলেও আর কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। রণিত চিৎকার করে ডাক্তারবাবুকে ডাকে, ডাক্তারবাবু এসে ফোর্সফুলি হার্টবিট ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত আর নবমীকে ফিরিয়ে আনা গেল না...........এক নিমেষে সব শেষ।

নবমীর মা, বাবা এই আকস্মিক শোকে পাথর হয়ে গেছেন। একমাত্র মেয়েকে হারাবার কষ্ট আর সহ্য করতে পারছেন না। সহজ, রনিত যে তাদের কি বলে সান্ত্বনা দেবে কিছুই বুঝতে পারছে না।
অফিসিয়াল যা যা ফরম্যালিটি ছিল,সহজ গিয়ে শেষ করল। কিন্তু এর পরেও একটা গুরুদায়িত্ব থেকে যায়। সহজ আর রনিত কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। ওরা অনুমতি নিল যাতে নবমীর শেষকৃত্য  হায়দ্রাবাদেই করতে পারে, আর  মীশমি সুস্থ হলে ওকে নিয়েই ফিরবে।

শেষকৃত্য শেষ করে যখন ওরা ক্লান্ত মনোরথে বাড়ি ফিরল তখন আর একটা নতুন দিনের সূর্য কিছু নতুন বার্তা নিয়ে উদিত হয়েছে। হসপিটাল থেকে জানায় মীশমীর জ্ঞান ফিরেছে।

—————————————-

এরপর কেটে গেছে দীর্ঘ পাঁচটা বছর। রনিত নিজস্ব কোম্পানি খুলেছে। বিয়ে করে কানাডার স্থায়ী বাসিন্দা। সহজ এখন ইন্ডিয়ান রেলওয়ের ইস্টার্ন শাখার সেকশন ইঞ্জিনিয়ার, মিশমিকে নিজের জীবনসঙ্গী  করেছে। যতটা পেরেছে মীশমিকে খুশী রাখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু যখনই মীশমি নবমীর কথা জানতে চেয়েছে প্রত্যেকবারই এক কথাই বলেছে, ওইরকম ক্রাইসিস থেকে সুস্থ হওয়ার পর বিদেশে একটা ভালো কোম্পানিতে চাকরী পেয়ে ওখানেই বিয়ে করে স্বামী সংসার নিয়ে সুখে শান্তিতে আছে। এই কথা বারবার শুনতে শুনতে মীশমিও একপ্রকার মেনেই নিয়েছে। কিন্তু মনে মনে কোনোদিনই মেনে নিতে পারেনি, একটু একটু করে রাগও মনের মধ্যে জমেছে।

একদিন রণিত ভিডিও কল করেছে সেই সূদুর কানাডা থেকে। অনেক বছর পর প্রিয় বন্ধুদের সাথে কথা হচ্ছে, একেবারে স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসেছে। কথায় কথায় নবমীর কথা উঠতেই মীশমি খুব রেগে গিয়ে বলল, "ওর কথা ছাড় তো, ওর মতো স্বার্থপর কেউ আছে? নিজের সুখের চেয়ে ওর কাছে কিছু মানে রাখে? মুখেই শুধু ভালবাসি, ভালবাসি। ভালোবাসা বজায় রাখতে গেলে নূন্যতম যোগাযোগ রাখতে হয়। ভালোবাসা!! আমার একটা খোঁজ নিয়েছে? বিয়ে করেছে তো কি হয়েছে?"
রণিত মিশমীকে বোঝানোর জন্য কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই সহজ "আমি তোকে পরে কল করছি" বলে কলটা কেটে দিল। আর ফোনটা বন্ধ করেই মীশমিকে সপাটে একটা চড়। হঠাৎ সহজের এমন ব্যবহারে মিশমী হতবাক।
— মারলি কেন? 
— কি বলছিস তুই জানিস? তোর কোনো ধারণা আছে তুই কার সম্বন্ধে কী বলছিস? এই যে সুন্দর পৃথিবীটা দেখতে পাচ্ছিস.... কার জন্য? এই যে একটা সংসার পেয়েছিস..., কার জন্য? এই যে তুই একটা অন্য মীশমি হয়েছিস..... কার জন্য?
মীশমি কিছুই বুঝতে না পেরে বলল, "কি পাগলের মতো বকে যাচ্ছিস?"
— হ্যাঁ,  রে আমি পাগল!! তাই তোকে এতদিন কিছু জানাইনি।
এরপর সহজ বলতে থাকে সেই ভয়াবহ অ্যাক্সিডেন্টের কথা, যাতে মিশমীর দুটো চোখই নষ্ট হয়ে যায়। মুখমণ্ডল এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় যে প্লাস্টিক সার্জারি করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। তোকে বাঁচানোর তো তবু অপশন ছিল। কিনতু নবমী তো আমাদের কোনো অপশনই দেয়নি। কারণ ও সেই সুযোগটাই নেয়নি। তোর ভালোবাসাকে আমরা হাজার চেষ্টা করেও সেইদিন বাঁচাতে পারিনি। কিন্তু নবমী আজএ বেঁচে আছে তোর চোখে-মুখে। নবমীর শেষ ইচ্ছা ছিল ও তোর মধ্যে দিয়ে সারাজীবন আমাদের ছুঁয়ে থাকবে। আমরা ওর শেষ ইচ্ছেটা রাখতে পেরেছি শুধু। মিশমী এতটুকু শোনার পর নিজেকে আর ঠিক রাখতে না পেরে জ্ঞান হারিয়ে সহজের  বুকে পড়ে গেল। জ্ঞান ফেরার পর মীশমি কাঁদতে কাঁদতে সহজকে জিজ্ঞেস করে "বলিস নি কেন?? কেন?? ....নবমী সবসময়ই কেন জিতে যাবে?"
— তোর কষ্ট হবে তাই নবমীর বারণ ছিল.......। সহজ নবমীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।

ওরা হঠাতই অনুভব করে একটা বাতাস কোথা থেকে যেন ভেসে আসছে। তার সাথে একটা প্রাণোচ্ছল হাসির শব্দ। বলে যাচ্ছে কিছু কথা, "না রে, আমি শুধু একা জিতিনি। জিতেছিস তুইও, আমার সবটুকু নিয়ে। জিতেছে আমাদের নিঃস্বার্থ ভালবাসা। তোর মনের মধ্যে যদি বাঁচার তাগিদ না থাকত, আমার কোনো কিছুই তোর কাজে লাগত না। তোর মধ্যে দিয়েই তো আমি বেঁচে থাকব, আর বেঁচে থাকবে আমাদের "সমীরণ".....॥

                                                                                                               
                                                                       
                                                                  তিতির দত্তগুপ্ত ©


--------|| সমাপ্ত ||--------

" সমীরণ " - প্রথম খন্ড | তিতির দত্তগুপ্ত



                   ভালবাসার অর্থ কি? শুধুই কি ভালবাসা নাকি ভাল মনের ভালো বাসা? নাকি নিজেকে হারিয়ে অন্যের মধ্যে বেঁচে থাকা? সময় বলুক।

        গল্পের শুরু বাঁকুড়া ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। সদ্য প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া নতুন নতুন কিশলয় এবং তাদের  নতুন করে জীবন শুরুর এক পর্যায়। সহজ, মীশমি, রণিত, নবমী চারটি চিরসবুজ ছেলেমেয়ে কাউন্সিলিংয়ে গিয়ে  আলাপ। ৮-৯ ঘন্টা একসাথে বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তা হতে হতে প্রাথমিক বন্ধুত্ব হয়েই যায়। সহজ, মীশমি কম্পিউটার সায়েন্স  আর রণিত, নবমীর ইলেকট্রনিক্স। মীশমি কলেজ হোস্টেলে থাকে। আর বাকীরা পেয়িং গেস্ট। তাহলেও  কলেজে একসাথে যাওয়া-আসা, উইকএণ্ডে ঘুরতে যাওয়া, প্রজেক্টের কাজে একে অপরকে সাহায্য করা, সব কাজ তারা মিলেমিশে করে। এদের সুদৃঢ় বন্ধুত্ব দেখে গোটা কলেজ তাদের একটা নামও দিয়েছে "সমীরণ"। নতুন কলেজ, ফার্স্ট ইয়ার, সিনিয়র দাদা-দিদিদের আলাপ করার নামে ছোটখাটো ইন্টারোগেশন্ লেগেই আছে। ফ্রেশার্স ওয়েলকামও হয়ে গেছে। এরা চারজনই শিল্পকলায় পারদর্শী। বিভিন্ন জায়গা থেকে শো পায়, নিজেদের হাতখরচটা উঠে আসে। কলেজের  ক্লাসটেস্ট, সেমিস্টার, রাত জেগে পড়া আবার সকালে উঠে পরীক্ষা দিতে যাওয়া— সব ভালোই চলছিল।

ফার্স্ট সেমিস্টার শেষ, একটু শান্তি। একসাথে সবাই  কলেজ থেকে ফিরছে। হঠাৎই সহজ বলে, "এই জানিস, তোদের একটা খবর দেওয়া হয়নি। আমরা একটা বড় শো পেয়েছি, তবে রাতের  অনুষ্ঠান। বেশ ভালো রেমুনারেশন দেবে বলেছে।" শুনে রণিত বলে, "দেখিস, সাথে দুটো মেয়ে আছে। কোনোরকম অসুবিধা যাতে না হয়।"
"আমরা তোদের সাথে সাথেই থাকব, নো চাপস্"- নবমী উত্তরে বলে। এত কথা হচ্ছে কিন্তু মীশমি একদম চুপচাপ। নবমী মীশমির কাঁধে হাত রেখে বলে, "কি রে তোর কি হয়েছে? তোর কি শরীর খারাপ লাগছে? চুপচাপ কেন?"
— না তা নয়, এমনি কথা বলতে ভালো লাগছে না।
— বলছি নবমী, তুই আজ আমার সাথে  থাকবি?
নবমী হেসে বলে, "উমমমমম্ ঠিক হ্যাঁ  দোস্ত, থাকুম তর লগে।"
সহজ, রণিত  দুজন ঠিক করে, অনুষ্ঠান কিভাবে সাজাবে সেটার একটা আলোচনা করে নেবে। তাই সহজের গেস্ট হাউসে রয়ে যাবে। মীশমিও নবমীকে নিয়ে  হস্টেলে চলে আসে। দুজনেই ফ্রেশ হয়ে  টিফিন করে নিয়ে বসে আছে। নবমী গল্প করেই যাচ্ছে, মীশমি  শুনছে। মাঝে মাঝে হাসছে আবার উত্তরও দিচ্ছে, কিন্তু সেই প্রাণবন্ত  ভাবটা  নেই। কিছুটা টেনশনে আছে বলে মনে হচ্ছে। হঠাৎই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে মীশমি বলে, "নবমী, আমি তোকে খুব ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি। আমাকে ছেড়ে চলে যাবি না তো।"
— আমিও তোকে ভালোবাসি। তাছাড়া  আমরা  চারবন্ধুই একে অপরকে খুব ভালোবাসি, এটা নতুন কি আছে? তাছাড়া হঠাৎ এইরকম কথা....
মীশমি একদৃষ্টে  তাকিয়ে থাকে। হঠাৎই নবমীকে জড়িয়ে ধরে, ঠোঁটে প্যাশনেটলি চুমু খায়। এটার জন্য নবমী প্রস্তুত ছিল না। একঝটকায় মীশমিকে নিজের কাছ থেকে দূরে ঠেলে দেয়। চিৎকার করে বলে ওঠে, "এটা  কি অসভ্যতামি!!! কি এসব??" ভয় পেয়ে মীশমিও সরে আসে। "তুই বিশ্বাস কর, আমি তোকে এতটাই ভালোবাসি, তোকে না দেখতে পেলে মনে হয় আমার চারপাশ  যেন কেমন ফাঁকা ফাঁকা। তোকে কারোর সাথে একটু বেশী কথা বলতে দেখলে আমি সহ্য করতে পারি না। তুই শুধু আমার। এই অনুভূতি গুলোর শুরু তোকে যখন কাউন্সিলিংয়ের দিন প্রথম দেখি সেদিন থেকে, কিন্তু লজ্জায় বলতে পারি নি। কেন যে আমার এইরকম হয়!!" মীশমি কাঁদতে কাঁদতে বলে।
নবমী মীশমিকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, "ঠিক আছে, আমাকে একটু  ভাবার সময় দে, আমি তোকে সব জানাব। তুই একটু  ঘুমানোর  চেষ্টা  কর, আমি তোর মাথায়  হাত বুলিয়ে  দিচ্ছি।" মীশমি ঘুমিয়ে পড়ার পর নবমী রুমের বাইরে গিয়ে সহজকে ফোন করে সমস্ত ঘটনা খুলে বলে। কিন্তু সহজ বা রণিত কেউই এই ব্যাপারে কিছু সমাধান দিতে পারে না। অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছু করা যাবেনা। পরের দিন সকালে মীশমি ঘুম ভেঙ্গে চোখ খুলে দেখে নবমী  হাতের ওপর মাথা রেখে শুয়ে ওর মাথায় চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে, "কি সোনামণি, ঘুম হয়েছে?" নবমী জিজ্ঞাসা করে। মীশমি ঘুমচোখে বলে, "উমমমমম হয়েছে।"
"ভালোবাসা টেবিলে রাখা একটা শূন্য পাত্র। তুমি  যেভাবে তাকে ভরতে চাইবে, সে সেই ভাবেই ভরবে" হাসতে হাসতে বলে  নবমী। মীশমি তড়াক করে বিছানা থেকে উঠে আনন্দে নবমীকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে.... এইভাবে মান অভিমানের পালা চলার পর নবমী  বলে, "শুধু ভালোবাসলে হবে? দুদিন পর অনুষ্ঠান, প্রিপারেশনটা কে করবে শুনি!!"
——————————

বেশ জোর কদমে চলছে ওদের প্রস্তুতি। অনুষ্ঠানের দিন আসন্ন। এতবড় অনুষ্ঠান, কিছু প্রথিতযশা ব্যক্তিত্বও সেখানে আমন্ত্রিত। প্রত্যেকেই  তাদের মা বাবাদের আমন্ত্রণ করেছে।

        অনুষ্ঠানের দিন সকালে সবাই কাছের একটা মন্দিরে পুজো দিতে গেল। বেলা ৩টে থেকে প্রোগ্রাম। উদ্যোক্তারা গাড়ি পাঠিয়ে দেবে সহজ-এর গেস্ট হাউসে,  ওখানে থেকে ওরা মীশমি আর নবমীকে তুলে নেবে। মীশমি, নবমী এখন একইসাথে থাকে। ফলে ওরা ওদের অনুভূতি গুলো একে অপরের সাথে শেয়ার করতে পারে। তার সাথে প্রচুর আদর, শাসন চলতে থাকে। তারা নিজেদের মধ্যে একটা কল্পিত স্বপ্নের  জাল বুনে চলে। ওরা ঠিক করে পড়াশোনা শেষ করে চাকরী নিয়ে বাইরে গিয়ে নিজেদের মতো করে থাকবে।
যথাসময়ে গাড়ি এসে ওদের পিকআপ করে নিয়েছে। ওরা গাড়িতেই একবার রিহার্সাল দিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। ওরা  দুটো গান সিলেক্ট করেছে (আমাদের গান তানিয়া from Madly Bangali আর K.K এর একটা গান, ইয়ারো দোস্তি), এর সাথে মীশমির কণ্টে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর 'উলঙ্গ রাজা' আবৃত্তি আর নবমীর সহযোগী নৃত্য। খোলা আকাশের নিচে সুন্দর মঞ্চ, চারিদিকে লোকারণ্য তাদের অনেকটাই অক্সিজেন দিল।

        ওদের বেশ ভালো লাগছে, ঝাঁ চকচকে গ্রীনরুমে ওরা বসে আছে। মনের মধ্যে চাপা টেনশন ও আছে। উদ্যোক্তারা জানিয়ে যান, যেসব প্রথিতযশা শিল্পীদের আসার কথা ছিল তাঁরা এসে গেছেন। ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়, মালবিকা বসু, অঞ্জন দত্ত এবং নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "আমি সাধারণ মেয়ে" আবৃত্তির মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সূচনা করলেন। এবার ওদের পালা। সহজের গিটারের এক মনোমুগ্ধকর মূর্চ্ছনায় প্রথমেই ওদের গ্রুপ পারফরমেন্স "ইয়ারো দোস্তি" গোটা অডিটোরিয়ামকে গলা মেলাতে বাধ্য করল। এরপর মীশমির গলায় "উলঙ্গ রাজা" শুনে অভিভূত হয়ে  বিশেষ অতিথির আসন থেকে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী স্টেজে এসে অনেক আশীর্বাদ করলেন। অতিথি আসনে যেখানে স্বয়ং অঞ্জন দত্ত বসে আছেন, সেখানে "আমাদের গান তানিয়া" আমরা একা কেন গাইব, অঞ্জন দত্তকে মঞ্চ ভাগ করে নেওয়ার প্রস্তাব দিল রণিত। একটা বেশ সরগরম ব্যাপার। মীশমি আর নবমীর পারফরমেন্স শেষ, ওরা ড্রেস চেঞ্জ করতে রুমে চলে গেল। 
"উফফফ!!!! অ্যাটলিস্ট পারফরমেন্সটা ভালো করে উতরে গেছে, এবার খুব ক্লান্ত লাগছে রে...." বলেই নবমী ধপাস করে বসে পড়ল সোফায়। মীশমি দাঁড়িয়ে দেখছে নবমীর রকমসকম। তারপর বোদ্ধার মতো বলল, "হুমমম... কিন্তু তোকে এখন যা লাগছে না.....।"  নবমী  তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, "এই তুই এখন বাইরে যা, আমি চেঞ্জটা করে নিই।"
— আররেরর... কেন আমার সামনেই কর না, সমস্যা কোথায়? আমি আর তুই কি আলাদা?
মীশমী হাসছে আর বলছে.... "সবসময় শুধু দুষ্টুমি, তাই না!! যা না বাবুই, লক্ষ্মী আমার। এখুনি মা-বাবা, ভাই দেখা করতে চলে আসবে" বলে নবমীকে একপ্রকার ঠেলেই রুম থেকে বের করে দিলো।

ওদিকে অনুষ্ঠান শেষ, সবাই খুব খুশি হয়েছে। উদ্যোক্তারাও খুব আনন্দিত হয়েছেন এবং রফা হওয়া টাকার থেকে একটু বেশিই ওদের খুশি হয়ে দিয়ে দিল। 
নবমী, মীশমি নিজেদের রুমে বসে আছে, নিজেদের মধ্যে গল্প করছে।
— কাল তো ভ্যালেন্টাইনস ডে, আমাদের সম্পর্কের প্রথম ভালবাসা দিবস। আমরা সারাদিনটা খুব আনন্দ করবো। তোর কি উপহার লাগবে বল, নবমী বলল।
— আমার কিছুই লাগবে না। তুইই তো আমার সবচেয়ে পছন্দের উপহার। এর থেকে ভাল উপহার আর হতেই পারে না।

পরের দিন সকালে নবমী ঘুম থেকে উঠে তাড়াতাড়ি স্নান করে রেডি হয়ে নেয়। রুমের জানলার পর্দা সরিয়ে দিতেই সকালের প্রথম রবি কিরণ মীশমির মুখে পড়ে তাকে আরো মোহময়ী করে তুলেছে। মনে হচ্ছে পরম মমতার চাদরে যেন জড়িয়ে আছে।

"ওই বাবুই ওঠ ওঠ"..... নবমী ডাকছে। " শুভ ভালোবাসা দিবস মীশমি, অনেক অনেক আদর। (একটু আদর করার পর)চল তোকে একটা জায়গায় নিয়ে যাব,তাড়াতাড়ি রেডি হ।
অবাক হয়ে মীশমি বলে, "এই সক্কাল সক্কাল কোথায় যাব?"
— চল-ই না।

শহর থেকে অনতিদূরে গ্রীন গার্ডেন পার্ক। চারিদিকে শুধু সবুজের সমারোহ। যদিও এটা একটা ম্যানমেড পার্ক, তবুও প্রকৃতি যেন তার রূপলাবণ্যে সেজে উঠেছে। সুন্দর নয়নাভিরাম পরিবেশ। নবমী আগে নেটে সার্চ করে দেখে রেখেছিল আর সাথে সাথে একটা গাড়ি বুক করে রেখেছিল। 
গাড়ি করে ওরা রওনা দিল, পথে অনেকবারই মীশমি জানতে চেয়েছে তারা কোথায় যাচ্ছে। নবমী বারবার একই কথা বলেছে, "এত অধৈর্য কেন? একটু সারপ্রাইজ থাক না!!"

পার্কের  কাছাকাছি আসতেই নবমী,  মীশমির চোখটা বেঁধে দেয়।
"আরে করছিসটা কী? জিজ্ঞাসা করে মীশমি। নবমী মীশমির হাত ধরে পার্কের মধ্যে নিয়ে গিয়ে একটা জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলে, "একটু অপেক্ষা কর, আসছি।"

কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এসে মীশমির চোখটা খুলে দিয়ে বলে, "দেখ তো তোর সারপ্রাইজটা পছন্দ হয় কিনা।"
মীশমি চোখ খুলে দেখে, ওর সামনে একটা টেবিলের উপর রাখা আছে এক তোড়া লাল-হলুদ গোলাপ, এক ঝুড়ি ক্যাডবেরি-চকলেট, আর একটা বড় টেডি, তাতে লেখা আছে "For My Valentine,  With Love,  Nabami"। মীশমি তো আনন্দে আত্মহারা হয়ে নবমীকে জড়িয়ে ধরল, "I LOVE YOU TOO..।"

        হাসতে হাসতে গল্প করতে করতে ওদের অনেকটা সময় কেটে গেছে। হঠাৎই বিকট একটা শব্দে পার্কটা কেঁপে উঠল। চারদিকে শুধু কালো ধোঁয়া, মানুষের ত্রাহি ত্রাহি রব। ধোঁয়ায় কিছু দেখা যাচ্ছে না। নবমী এইরকম আকস্মিক ঘটনায় হতচকিত হয়ে গেছে। "মীশমি... মীশমি..." বলে চিৎকার করছে, কিন্তু কোন উত্তর আসছে না।
কিছুক্ষণ পরে ধোঁয়াটে ভাবটা একটু পরিষ্কার হতে, চারদিকে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও মীশমিকে কোথাও দেখতে পেল না। নবমী এবার ভয় পেয়ে কাঁদতে শুরু করেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছে কিছু মুখে কালো কাপড়ে ঢাকা বন্দুকধারী হঠাৎই পার্কে ঢুকে পড়ে বোমাবাজি করে। একটা ২২-২৩ বছরের মেয়েকে জোর করে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। পার্কের অথরিটির লোকেরা বাধা দিতে গেলে তাদের কয়েকজনকে বন্দুকের আঘাতে জখম করে পালিয়ে গেছে। নবমী মেয়েটার বিবরণ দিতেই তারা বলল, "হ্যাঁ হ্যাঁ... এইরকমই পোষাকে ছিল।" নবমী এবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে, কি করবে কিছু বুঝতে পারছে না। ততক্ষণে খবর পেয়ে লোকাল থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করার চেষ্টা করছে। আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছে। নবমী পুলিশের কাছে গিয়ে মীশমির পুরো বিষয়টি জানালে একটা মিসিং ডায়েরি করার পরামর্শ দেন থানার আইসি। সহজ আর রণিত দুজনের কেউই বাঁকুড়াতে ছিল না। ওরা কিছুদিনের জন্য শান্তিনিকেতন গেছিল সহজের মাসতুতো দাদার বাড়ি। নবমীর কান্না ফোনের ওপার থেকেও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল। কিছু গড়বড় হয়েছে এটা আন্দাজ করে নিয়ে দাদা বললেন, "কী হয়েছে রে পাপুন? (সহজের ডাক নাম)কিছু সমস্যা?" সহজ তখনি সব ব্যাপারটা সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করে। শুনে তো মাথায় হাত দাদার। কিছু একটা চিন্তা করে বললেন, "আমি যেটা ভাবছি সেটাই যদি হয়, তাহলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদেরকে অপারেশনে নামতে হবে। তার আগে থানার আইসির সাথে কথা বলতে হবে। তোরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাঁকুড়া থানায় পৌঁছা,  আমি একটা ফোন করে আসছি।"

সহজ, রণিত থানায় পৌঁছতেই নবমী ওদের জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। সে বারবার একটাই কথা বলতে থাকে, "আমার জন্যই সবটা হয়েছে, আমার আরো সতর্ক হওয়া উচিত ছিল।" ওরা সান্ত্বনা দিয়ে বলে, "তোর তো এতে কোন দোষ নেই। এটা একটা আনএক্সপেক্টেড অ্যাক্সিডেন্ট। ভয় পাসনা সব ঠিক হয়ে যাবে,  আমরা থাকতে মীশমির কিছু হবে না।"
এদিকে নবমী এই পুরো ঘটনাটার জন্য নিজেকে দায়ী করে অনুশোচনার আগুনে পুড়তে লাগলো। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, যে সে থাকতে মিশমীর কোনরকম ক্ষতি হতে দেবে না। ইতিমধ্যেই একজন নিজের ইউনিফর্মে থানায় এসে ঢুকলেন, আইসির সাথে কেসটার ব্যাপারে বিস্তারিত কথা বললেন। সহজ, রনিত ও নবমী দাদার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে। সহজ দাদাকে ফোন করতে যাবে, তখনই পেছন থেকে পাপুন বলে কেউ যেন ডাকল। ফিরতেই দেখে কাবুল দা ওরফে ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের হেড অফ দি ডিপার্টমেন্ট সঙ্কর্ষণ রায়। ওরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, "তুমি এই পোষাকে?"
— তোদের তো বলাই হয়নি। আমি মাস দুয়েক হল এখানে জয়েন করেছি।  ভেবেছিলাম সারপ্রাইজ দেব কিন্তু সেটা করার আর সময় হলো না। যাই হোক, কাজের কথায় আসি। মিশমীর কাছে যে একটি মোবাইল ফোন ছিল সেটার মোবাইল টাওয়ার লোকেশন ট্রেস করা যায় কিনা সেটা দেখার জন্য বলে দিয়েছি। সমস্ত পুলিশ স্টেশনে মিশমীর ছবি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিছু খবর পেলেই তোদের জানাব। চিন্তা করিস না।
কাবুল দার কথায় সেদিন তিনজন ফিরে এসেছিল। কিন্তু মিশমীর কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে যত দিন এগোচ্ছে নবমী মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে। এর মধ্যেই হঠাৎ একদিন নবমীর নাম্বারে একটি ফোন আসে। কিন্তু নবমী মানসিকভাবে এতটাই বির্পযস্ত যে কোনো ফোনকলই রিসিভ করেনা। দুবার তিনবার একইভাবে বেজে যাওয়ার পর নবমী কলটা রিসিভ করল। আর সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠল।

                                                                   
                                                                  তিতির দত্তগুপ্ত ©



                                                       =>>  দ্বিতীয় খন্ড